বাংলাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন দীর্ঘদিন থেকেই জনআতঙ্ক তৈরি করে আসছে। কে কখন কিভাবে ভবনধসে মারা যাবে কেউ বলতে পারে না। জাতিসংঘের হিসাবে সর্বোচ্চ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে থাকা দুটি শহরের একটি ঢাকা। সম্প্রতি নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্প হওয়ার পর বাংলাদেশেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশের মানুষ আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার মানুষ সবচেয়ে বেশি আতঙ্কগ্রস্ত। কারণ, ঢাকাতেই রয়েছে অধিকসংখ্যক ঝুঁকিপূর্ণ ভবন।
২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর দুর্যোগ প্রশমন দিবস উপলক্ষে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, রাজধানীর অতি ঝুঁকিপূর্ণ ৩২১টি ভবন ৩০ দিনের মধ্যে ভাঙতে ২০১৬ সালের ২৮ এপ্রিল নির্দেশ দেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ১৭ মাস পার হলেও সব ভবন অপসারণ করতে পারেনি রাজউক ও দুই সিটি করপোরেশন। ঝুঁকিপূর্ণ সাইনবোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বসবাস চলছে।
রাজধানীর অগণিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের প্রতীকী চিত্র যেন এ ভবনগুলো। এই ৩২১ ভবনের তালিকার বাইরে আরও কত ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, তার হিসাব নেই সরকারের কাছে। প্রায় এক দশক আগে করা জরিপের হিসাবে বলা হয়ে থাকে, রাজধানীর ৭২ হাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। এ জরিপের পর আরও কত ভবন নিয়ম-নীতি না মেনে বানানো হয়েছে, হিসাব নেই তারও।
২০০৯ সালে রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা নির্ধারণ করে রাজউক। তবে এ প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। জরিপে বলা হয়েছে, ৭২ হাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন জানান, কোন ভবন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, ভূমিকম্পে বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এ বিষয়ে বিশদ তথ্য নেই কারও কাছেই।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিতকরণ জরিপে যুক্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেহেদী হাসান আনসারী জানান, মাত্র ১০টা ভবনের কারিগরি দিকসহ সবকিছু যাচাই করা হয়েছিল। বাকিগুলো চিহ্নিত করা হয় সাধারণ পর্যবেক্ষণে। তিনি জানান, ২০০৯ সালে তখন ঢাকায় ভবনের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ২৬ হাজার। গড় হিসাবে বলা হয়, ৭২ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে।
২০১১ সালে ফায়ার সার্ভিসের জরিপে বলা হয়েছে পাঁচ হাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। তা নির্ধারণ করা হয় ভবনের অঘ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ও ভৌত অবস্থার ভিত্তিতে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ) মেজর শাকিল নেওয়াজ জানান, দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশেষত অঘ্নিনির্বাপণে প্রধান বাধা নকশা না মেনে ভবন নির্মাণ।
এদিকে, ২০১১ সাল থেকে জাইকার সহযোগিতায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তর পরিচালিত চার বছর মেয়াদি এক জরিপে দেখা যায়, গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে নির্মিত ঢাকার ২ হাজার ১৯৩টি সরকারি ভবনের ৫৯ শতাংশই ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অধিকতর ঝুঁকিতে রয়েছে। ভবনগুলোর বয়স ২০ বছরের বেশি ও ইটের গাঁথুনিতে তৈরি।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল এর আগে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ভূমিকম্প-পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের হাতে আধুনিক উদ্ধার যন্ত্র রয়েছে। সাধারণ মানুষ জানেন, কীভাবে ভূমিকম্পের সময় নিজেকে রক্ষা করতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি হলেও, পরিকল্পিত ভবন নির্মাণ বন্ধ না হওয়ায় ঝুঁকি দূর হচ্ছে না।
তবে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলে জানান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান। তিনি জানান, সিটি করপোরেশন ও সিডস এশিয়ার সহায়তায় কল্যাণপুরের পাইকপাড়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে কল্যাণ সমিতি গড়ে উঠেছে। এ সমিতির পক্ষ থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের বোঝানো হয়েছে, নিজেদের স্বার্থেই বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করতে হবে। নির্ধারিত পরিমাণ জমি ফাঁকা রাখতে হবে যেন দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে উদ্ধার কাজ সহজ হয়। কাউন্সিলর জানান, সাধারণ মানুষ তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিয়ম মেনে বাড়ি করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একটা একটা করে ভবন পরীক্ষা করা ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার উপায় নেই। এ জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তর, রাজউক, দুই সিটি করপোরেশন এবং ফায়ার সার্ভিসকে সম্মিলিতভাবে একটি জরিপ করতে হবে। এ জন্য ভবনের নকশা, মাটির অবস্থা, কলাম, বিম, নির্মাণসামগ্রীসহ বিভিন্ন সূচক নির্ধারণ করে নিতে হবে।
সম্পাদনা: আরএ/আরবি/এসএ