
সিরামিক শিল্প বাংলাদেশের একটি ক্রমবর্ধমান উৎপাদন খাত। ১৯৫৮ সালে এদেশে সিরামিক শিল্প (তৈজসপত্র, টাইলস্ স্যানিটারিওয়্যার) বিপ্লব ঘটে। এক সময়ের শতভাগ আমদানি নির্ভর শ্রমঘন এ শিল্প আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। উন্নত প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি ব্যবহারে উৎপাদিত পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানিও হচ্ছে। অপরদিকে, সৃষ্টি হয়েছে বিশাল কমসংস্থান। এ খাত থেকে বছরে কোটি টাকার ওপরে রাজস্ব আদায় হচ্ছে। তবে; সম্প্রতি বিদেশে টাইলস রপ্তানিকে বাধাগ্রস্ত করতে একটি চক্র উঠেপড়ে লেগেছে। এমতাবস্থায়, টাইলস আমদানি-রপ্তানিতে নীতিমালা প্রণয়নের দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা।
তাঁরা বলেছেন, সরকারের নীতি-সহায়তা পেলে তৈরি পোশাকের মতো বিদেশে বিপুল পরিমাণ টাইলস রপ্তানি সম্ভব। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানি সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন। কারণ, ১১ প্রকারের টাইলসের মধ্যে বাংলাদেশে শুধু তিন ধরনের টাইলস উৎপাদন হয়। বাকিগুলো আমদানিনির্ভর। এ প্রেক্ষিতে সরকার নীতিমালার মাধ্যমে উন্নতমানের টাইলসের বিস্কুট আমদানিতে শুল্ক হ্রাসের সুযোগ দেয় তাহলে দেশে অনেক পলিশিং ফ্যাক্টরি গড়ে উঠবে এবং এসব ফ্যাক্টরি থেকে বিদেশে ফিনিশড টাইলস রপ্তানি সম্ভব হবে।
চলতি বছরের ৮ নভেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে টাইলস রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-তাইওয়ান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড আমদানি-রপ্তানিতে নীতিমালার এ দাবি জানায়। টাইলস ডিলার্স অ্যান্ড ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের বিজ্ঞাপনের প্রতিবাদে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান শরীফ বলেন, বাংলাদেশ-তাইওয়ান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেটি আনগ্লেজড/আনফিনিশড টাইলস আমদানির পর পলিশিং করে বিদেশে রপ্তানি করছে। কিন্তু একটি অসাধু চক্র কাস্টমসকে ভুল বুঝিয়ে রপ্তানিতে বাধার সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি শুল্ক গোয়েন্দা চট্টগ্রাম কাস্টমসে ৪০ কন্টেইনার আনগ্লেজড/আনফিনিশড টাইলস আটক করেছে। তাদের দাবি, এগুলো ফিনিশড প্রোডাক্ট। অথচ বুয়েট টেস্টে প্রমাণিত হয়েছে, এগুলো আনগ্লেজড টাইলস। এ অবস্থায় একদিকে বিদেশি ক্রেতারা তাদের অর্ডার ফিরিয়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে বন্দরের মাশুল গুণতে হচ্ছে।
হাসান শরীফ আরও বলেন, এনবিআর থেকে শুল্ক গোয়েন্দা, বন্ড কমিশনারেট, কাস্টমস হাউজের প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করে ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করলে সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে। তার আগে বন্দর থেকে টাইলসগুলো অঙ্গীকারনামা অথবা বন্ডের মাধ্যমে খালাস জরুরি। কারণ, ব্যাংক ঋণের সুদ দিন দিন বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে রপ্তানি বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। এতে একটি সম্ভাবনাময় খাতের অপমৃত্যু ঘটবে।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক জিয়াউদ্দিন বলেন, বিদেশে টাইলস রপ্তানিকে বাধাগ্রস্ত করতে একটি চক্র উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের ধারণা, বন্ড সুবিধার আওতায় আনগ্লেজড/আনপলিশড টাইলস আমদানির পর সেটি পলিশ করে খোলা বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ-তাইওয়ান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ সব টাইলস বিদেশে রপ্তানি করেছে, যার সব প্রমাণ আছে। কাস্টমসের ভুল সিদ্ধান্ত ও টাইলস ডিলার্স অ্যান্ড ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের অপপ্রচারের কারণে বর্তমানে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
জিয়াউদ্দিন বলেন, তৈরি পোশাকের পর টাইলস রপ্তানিতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। বর্তমানে ভারতে ৪০০-এর বেশি পলিশিং ফ্যাক্টরি আছে। এসব ফ্যাক্টরির ফিনিশড টাইলস রপ্তানি করে ভারত দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানিকারক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। টাইলসের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ চীনে সাত হাজারের বেশি পলিশিং ফ্যাক্টরি আছে। শ্রমের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখান থেকে কারখানা স্থানান্তরের কথা ভাবছেন উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আরও বলেন, বিদেশি টাইলস রপ্তানিতের পর দেশীয় বাজারে উন্নতমানের টাইলস সরবরাহের জন্য মধুপুরে কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। এ কারখানায় বডি তৈরির পর তা পলিশ করে বাজারে সরবরাহ করা হবে। তখন চীন থেকে ফিনিশড টাইলস আমদানির প্রয়োজন হবে না। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। মূলত আমদানির পথ সংকুচিত এবং অবৈধ মুনাফার পথ বন্ধ হওয়ায় টাইলস ডিলার্স অ্যান্ড ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের অপপ্রচার শুরু করেছে।
জানা যায়, কিছু অসাধু টাইলস আমদানিকারক বন্ডের আওতায় শুল্ক্কমুক্ত সুবিধার নামে সম্পূর্ণ তৈরি বা ফিনিশড টাইলস আমদানি করে শুল্ক্ক ফাঁকি দিচ্ছেন। সম্প্রতি এ রকম একটি অসাধু চক্রের সন্ধান পায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীন শুল্ক্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর। তাঁরা বন্ড সুবিধার আওতায় (বিনা শুল্ক্কে) কাঁচামালের নামে তৈরি করা পণ্য বা ফিনিশড সিরামিক নিয়ে এসেছে। এরপর তা খোলাবাজারে বেশি দামে বিক্রি করে দিচ্ছে।
শুল্ক্ক গোয়েন্দাদের মতে, অভিযুক্ত বাংলাদেশ-তাইওয়ান সিরামিক প্রতিষ্ঠান চীন থেকে যেসব টাইলস আমদানি করেছে, তা পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে পরীক্ষা করে দেখা যায়, কাঁচামালের নামে আনা পণ্যগুলো ফিনিশড টাইলসের মতো।
এনবিআর সূত্র জানায়, পণ্যের শ্রেণীকরণ বা এইচএস কোড অনুযায়ী, আমদানি করা টাইলসগুলো বন্ড সুবিধার আওতায় পড়ে না। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস ও বন্ড অফিস সূত্র বলেছে, সম্পূর্ণরূপে তৈরি বা ফিনিশড টাইলস শুধু পলিশড না থাকার কারণে তা কাঁচামাল হতে পারে না। টাইলস তৈরির জন্য শুধু মাটি ও কেমিকেল আমদানি করার ক্ষেত্রেই বন্ড সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। এদিকে, বাংলাদেশ-তাইওয়ান সিরামিক ফ্যাক্টরি টাইলসের কাঁচামাল আমদানির পরিবর্তে ফিনিশড টাইলস মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি করে থাকে বলে জানানো হয়েছে।
সাধারণত ফিনিশড টাইলস আমদানিতে প্রতি বর্গমিটারে মোট শুল্ক্ককর দিতে হয় প্রায় ১৫১ শতাংশ। পক্ষান্তরে, কাঁচামাল হলে সে ক্ষেত্রে শুল্ক্ক দিতে হয় না। কাঁচামাল এনে তা দিয়ে পণ্য তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করতে হবে- এমন শর্তে উদ্যোক্তাদের বন্ড লাইসেন্স দেয় এনবিআর। রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে কাঁচামাল আনতে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হলেও বন্ড সুবিধা অপব্যবহার করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
সূত্র জানায়, গত ৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছার পর শুল্ক্ক গোয়েন্দারা ৪০ কনটেইনার টাইলসের নমুনা সংগ্রহ করেন। এতে দেখা যায়, টাইলসের ওপরে পলিশ করা হয়নি। বর্তমানে বাজারে আনপলিশড টাইলসও অহরহ বিক্রি হচ্ছে। জানা যায়, বাণিজ্যিকভাবে আমদানি করা টাইলসের কেজি প্রতি দাম সাধারণত পৌনে ১৩ টাকার কমবেশি হয়। অন্যদিকে, জব্দ করা টাইলসের প্রতি কেজি ঘোষিত মূল্য দেখানো হয়েছে সাত টাকা ৬৮ পয়সা। সংশ্নিষ্টদের মতে, আধুনিক মেশিনের ক্ষেত্রে প্রতি কেজি টাইলস পলিশ করতে পাঁচ/ছয় টাকার বেশি লাগার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে আমদানি মূল্য কম দেখানো হয়েছে কি-না, তাও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন।
শতকরা ৯৫ ভাগ টাইলস আমদানি হয় চীন থেকে। এগুলো খালাস হয় চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের মাধ্যমে।
সংশ্নিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি করা প্রতি বর্গফুট টাইলসের প্রকৃত মূল্য ১০ ডলার। অথচ কাস্টমসের কাছে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে চার থেকে পাঁচ ডলার, অর্থাৎ এই পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ মূল্য কারসাজি করার অভিযোগ উঠেছে। এভাবে কম মূল্য দেখিয়ে টাইলস আমদানি করায় প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিরামিক ওয়্যারস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা এর আগে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, কিছু অসাধু চক্র মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে টাইলস আমদানি করছে। ফলে এ পণ্যের দাম বাজারে তুলনামূলক কম হওয়ায় দেশি টাইলস প্রতিযোগিতায় মার খাচ্ছে। শুল্ক্ক ফাঁকি রোধ না করলে স্থানীয় শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়েবে বলে আশঙ্কা করেন তিনি।
বাংলাদেশ টাইলস ডিলার্স অ্যান্ড ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইউসুফও বলেছিলেন, মিথ্যা ঘোষণার কারণে টাইলসের বাজারে অস্থিরতা চলছে। বন্ড সুবিধা অপব্যবহার করে যারা ফিনিশড টাইলস আনেন, তাদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে স্থানীয় চাহিদার ৭২ শতাংশ টাইলস দেশি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করছে। বাকি ২৮ ভাগ আমদানি হচ্ছে। ছোট-বড় মিলে টাইলসের ফ্যাক্টরি ২৬টি। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বছরে ১২০ মিলিয়ন বর্গমিটার বা ২৫ কোটি পিস টাইলস তৈরি হয়। গত অর্থবছরে টাইলস আমদানি হয়েছে ৫৭৬ কোটি টাকার। চাহিদার শতভাগ টাইলস দেশি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন না করতে পারলেও কিছু টাইলস রপ্তানি হচ্ছে। গত অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ১৯ কোটি টাকার টাইলস রপ্তানি হয়েছে। বর্তমানে প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানিসহ বিশ্বের ৫০টি দেশে বাংলাদেশি টাইলস রপ্তানি হচ্ছে।
সম্পাদনা: আরএ/আরবি/এসএ