আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
আবাসন শিল্পের সংকট উত্তরণে রিহ্যাবের দাবী ও প্রস্তাবনা সূমহ

বাংলাদেশের আবাসন শিল্পের সংকট হতে উত্তরণে বেশ কয়েকটি দাবী ও প্রস্তাবনা উপস্থাপনা করেছে রিয়েল এস্টেট এ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। শনিবার (১১ নভেম্বর) বেলা ১১টায় রাজধানীর মতিঝিলে হোটেল পূর্বাণী ইন্টারন্যাশনালে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় সংগঠনটির নেতৃবৃন্দের দাবী ও প্রস্তাবনাগুলো নিম্মে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:

১. বর্তমানে বাংলাদেশের রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত ব্যয় ১৫.৫%। এরমধ্যে গেইন ট্যাক্স ৪%, স্ট্যাম্প ডিউটি ৩%, রেজিস্ট্রেশন ফি ২%, স্থানীয় সরকার কর ২% এবং ভ্যাট ৪.৫% (১.৫% থেকে ৪.৫%)। অন্যান্য সার্কভুক্ত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের রেজিস্ট্রেশন ব্যয় অতি উচ্চ। এই রেজিস্ট্রেশন ব্যয় ৬.৫% এ কমিয়ে আনা জরুরি। রেজিস্ট্রেশন ব্যয় কমিয়ে নিয়ে আসলে নাগরিকরা সঠিক দলিল মূল্য দেখাতে আগ্রহী হবে ফলে রাজস্ব আয় আরো বাড়বে।

২. বর্তমানে আবাসন খাতে যথাযথ অর্থ প্রবাহ না থাকা ও নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এ খাতের ক্রেতারা কোন বিনিয়োগে যাচ্ছে না। ফলে নতুন করে আবাসন খাত আরো সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আবাসন ব্যবসায়ীরা তাদের কনস্ট্রাকশন সাইট গুলোতেও নির্মাণ কাজ করতে না পারায় নির্মাণ কাজ বিলম্বিত হচ্ছে বিধায় নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে ডেভেলপারদের জন্য ৫টি শ্রেণীতে আবাসিকে প্রতি বর্গমিটারে ৩০০ টাকা থেকে ১৬০০ টাকা আয়কর দিতে হচ্ছে। এছাড়া, বাণিজ্যিক এ প্রতি বর্গমিটারে দিতে হচ্ছে ১২০০ টাকা থেকে ৬৫০০ টাকা। উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত কর ৮২ (সি), ২ (এ, বি) ধারা অনুযায়ী নূন্যতম কর আদায় হিসেবে গণ্য করা হয়। উপরে বর্ণিত হারে ডেভেলপারগণ আয়কর পরিশোধের পরও তাদের স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের ব্যালেন্স সীটের মুনাফার পরিমাণ প্রদর্শন করার পরও “চূড়ান্ত কর দায়মুক্তি” না থাকায় ফাইল রি-অপেন করার কথা বলছে কর অঞ্চল সমূহ। এমতাবস্থায় রিহ্যাব মনে করে প্রতি বর্গমিটারের আবাসিকের জন্য ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা এবং বাণিজ্যিক এর জন্য প্রতি বর্গমিটারে ৫০০টাকা থেকে ২৫০০ টাকা আয়কর নির্ধারণ করা আবশ্যক এবং উক্ত ধারায় কর্তনকৃত কর চূড়ান্ত করদায় হিসেবে গণ্য করার প্রস্তাব করছি।

৩. আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪- এর ধারা ৫৩চ অনুসারে জমির মালিককে প্রদত্ত সাইনিং মানিসহ যে কোন প্রকার অর্থের উপর ১৫% হারে কর প্রদান করতে হয়। অনেক সময় টাকা জমির মালিক দিতে চায় না। যেটা পরিশোধ করতে হয় ল্যান্ড ডেভেলপারকে। ফলে ফ্ল্যাট এর নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যায়। এই গেইন ট্যাক্স ১৫% থেকে কমিয়ে ৭.৫% করে জমির মালিকের জবমঁষধৎ ধংংবংংসবহঃ এর মাধ্যমে সংগ্রহ করা জরুরি। উক্ত ট্যাক্স্রের পরিমাণ কমানো হলে এ্যাপার্টমেন্টের মূল্য ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনতে সাহায্য করবে এবং মন্দা কাটিয়ে উঠতে সরকার থেকে নীতিগত সহায়তা পাওয়া যাবে।

৪. প্রতিটি নির্মাণ সামগ্রীর প্রাইমারী ও সেকেন্ডারি ভ্যাট সরকার পাচ্ছে ফ্যাক্টরী ও পাইকারী বিক্রেতা থেকে। ভবন নির্মাণকালে অধিকাংশ ডেভেলপারের অফিসিয়ালরা সরাসরি নগদ অর্থে ইট, বালু, দড়ি, গুনাতারসহ বিভিন্ন প্রকার নির্মাণ সামগ্রী ও সেবা ক্রয় করে থাকে। ফলশ্রুতিতে ভ্যাট ও উৎস কর সংগ্রহের দায়িত্ব পালন সম্ভবপর হয় না। এছাড়া, অনেক নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহকারী পুরা-পুরি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে না বিধায় এই সকল ভেন্ডরের নিকট থেকে প্রামাণিক কাগজপত্র সংগ্রহ করা যায় না। নিয়মতান্ত্রিক না হওয়ার কারণে ডেভেলপারগণ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। রিহ্যাব মনে করে এনবিআর প্রাথমিকভাবে এই সব প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট দেওয়ার ব্যাপারে সচেতন করবে। তারা একটা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের মধ্যে চলে আসলে তখন আমাদের সাপ্লায়ার ভ্যাট ও উৎস কর সংগ্রহের দায়িত্ব যেতে পারে।

৫. আমাদের দেশের ফ্ল্যাটের সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থা নেই। সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্তা গড়ে উঠলে নতুন একটা পেশাজীবি গড়ে উঠবে। এই সেক্টরে কর্মচাঞ্চল্য তৈরি হবে। সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থার প্রচলন একদিকে যেমন এই শিল্পকে এগিয়ে নিবে তেমনি বাজারে অর্থের লেনদেনও বাড়বে, অন্যদিকে সরকারও তার রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে। এ বিষয়ে গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের বিষয় টা উল্লেখ করার মত। প্রথমবার গাড়ী রেজিস্ট্রেশনে যে ব্যয় হয় দ্বিতীয় বার বিক্রির ক্ষেত্রে বা পরবর্তীতে আবার বিক্রির ক্ষেত্রে এই রেজিস্ট্রেশন ব্যয় অনেক কম। গাড়ীর মত আমরা ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য এই ব্যবস্থা চাই। পুন: বিক্রয়ের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়াসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মত রেজিস্ট্রেশন খরচ সর্বমোট ৩% নির্ধারণ করে সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থার প্রচলন করা এখন সময়ের দাবি।

৬. আবাসন শিল্প রক্ষার্থে অবিলম্বে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক রি-ফাইন্যান্সিং ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। বিগত ২০০৮-০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতায় আবাসন খাতে সিঙ্গেল ডিজিট সূদে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। যা এই খাতে ক্রেতাদের জন্য অনেক ফলপ্রসূ ভূমিকা রেখেছিল। অনেকে নিজের কিছু মূলধন নিয়ে প্রায় ভাড়ার টাকায় ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এই ঋণ সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে এই খাত সংকটের মধ্যে পতিত হয়। আমরা চাই, ক্রেতা সাধারণ চাহিদামত ঢাকা শহরের আশে-পাশে বা মিউনিসিপ্যাল এলাকার পার্শ্বে ১৫০০ বর্গফুট বা তার চেয়ে ছোট ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য ৫% সুদে ২০ থেকে ৩০ বছরের কিস্তিতে ঋণ দিলে ক্রেতা সাধারণ ভাড়া সমান কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করতে পারবে। এমতাবস্থায়, আবাসন খাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ২০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করে ৫% সূদে ৩০ বছর মেয়াদে দীর্ঘমেয়াদী রি-ফাইন্যান্সিং চালুকরণ অতীব জরুরি, যাতে মাসিক কিস্তি বাসা ভাড়ার সমান হয়। এছাড়া প্রথম ক্রেতার জন্য নূন্যতম মাথা গোজার ঠাঁই হিসেবে ৫% সূদে হাউজিং লোন দেয়ার দাবি জানাই।

৭. বর্তমানে আবাসন খাত শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু শিল্প খাত হিসেবে স্বীকৃত হলেও শিল্প খাতের সুবিধা পাচ্ছে না আবাসন খাত। শিল্প সুবিধা প্রদানের জন্য এনবিআর সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

৮. ক্রেতা, জমির মালিক ও ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য অসমাপ্ত প্রকল্পগুলোতে বিশেষ ঋণের প্রচলন করতে হবে। বর্তমানে ফ্ল্যাট ক্রেতা, ভূমির মালিক ও ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান যে সংকটে পড়েছে তা থেকে সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া উত্তরণের কোন পথ নেই। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ নানাভাবে আইনগত জটিলতায় জড়িয়ে পড়বে। তাই এই বিষয়ে একটি বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।

সভায় স্বাগত বক্তব্যে রিহ্যাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সংসদ সদস্যে নুরুন্নবী চৌধুরী (শাওন) এসব দাবী ও প্রস্তাবনা উপন্থাপন করেন।

প্রথমবারের মতো রিয়েল এস্টেট এ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এই যৌথ আলোচনা সভার আয়োজন করে। রিহ্যাব প্রেসিডেন্ট মো. আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল) এর সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্যে রাখেন এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, এনবিআর সদস্য (ভ্যাট) ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর হোসেন, সদস্য (ইনকাম ট্যাক্স) মো. পারভেজ ইকবাল ও রিহ্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট (প্রথম) লিয়াকত আলী ভূইয়া। সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শামসুল আলামিন।

সভায় এনবিআর ও রিহ্যাবের বর্তমান এবং সাবেক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

সম্পাদনা: আরএ/আরবি/জেডএইচ