আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
রিয়েল এস্টেটের প্রতারণা, নি:স্ব অনেকেই

রিয়েল এস্টেট খাত দেশে আবাসিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা পালন করলেও কিছু ডেভলোপার কোম্পানি সময়মত ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দেয়া ও তালবাহানার কারণে অনেকেই ভুক্তভোগী হয়ে পড়ছেন এবং এ খাতের দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ছে। স্থূল ও সূক্ষ্ম উভয়ভাবে প্রতারণা করা হচ্ছে জমির মালিক ও ফ্ল্যাট ক্রেতার সাথে। সময়মতো বা ছয় মাস বর্ধিত সময়ের মধ্যেও সম্পূর্ণভাবে নির্মাণ, স্থাপনা, ফিটিংস ইত্যাদি সমাপ্ত করে ফ্ল্যাট হস্তান্তর না করার মাধ্যমে অনেকে প্রতারণার শিকার হলেও করার কিছুই থাকছে না। প্রথমত বিলম্ব হয়, কিন্তু বিলম্বের জন্য চুক্তি অনুযায়ী জমির মালিককে ভাড়ার টাকা পরিশোধ করেন না অনেক ডেভেলোপাররা। তারপর অনেক ক্ষেত্রে পদ্ধতিগতভাবে জমির মালিকের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি করেন না তাঁরা। কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই ডেভেলপার আত্মগোপনে যায়। অফিস পরিবর্তন এমন কি ফোন না ধরার কৌশলকে বেছে নেয় এক শ্রেণীর প্রতারক ডেভেলোপাররা। জমির মালিককে চাঁদাবাজ সাজিয়ে মামলা মোকদ্দমা করতে পিছ পা হন না তাঁরা।

জমির মালিকরা বলছেন, পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে নিজেরা বাড়ি করতে না পারায় আবাসন কোম্পানিকে জমি দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন। এখন তাঁরা অন্যের বাড়িতে ভাড়া থেকে থেকে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন। ধারদেনা করে ভাড়া মেটাতে হচ্ছে। বাড়ির স্বপ্ন অনেকের দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। চুক্তির পর আবাসন কোম্পানি দীর্ঘদিন জমি আটকে রাখায় নিদারুন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন জমির মালিকরা।

অনেক ক্ষেত্রে ফ্ল্যাট ক্রেতারা বাধ্য হয়েই বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা মুখ বুজে মেনে নিয়ে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে ফ্ল্যাট বুঝে নিতে চায়। শেষমেষ ‘ভিক্ষা চাই না বাবা কুত্তা সামলাও’ অবস্থার শিকার হয়ে ফ্ল্যাট নিবন্ধন করে হাঁফ ছেড়ে বেঁচতে চান ক্রেতারা। কিন্ত এতে সমস্যা আরো জটিল হয়। যখন ডেভেলপার কোম্পানি জমির মালিককে তার পাওনা বুঝিয়ে না দিয়ে ধোঁকাবাজিতে আত্মনিয়োগ করে। অনেকে ধর্ম এবং ধর্মীয় লেবাসকে হাতিয়ার বানায় এ ব্যবসায়। সন্ত্রাসী, পুলিশ আর দালালদের পেছনে অর্থ ব্যয় করে জমির মালিককে বিপাকে ফেলানোর জন্য। তাতেও শেষ রক্ষা হয় না ডেভেলোপারদের। এরই মধ্যে রিয়েল এস্টেট এ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)  বেশ কিছু সদস্যকে বহিস্কার করেছে। তবে বেশি প্রতারণা করছে রিহ্যব এর সদস্য নয় এমন প্রতিষ্ঠান। ভুক্তোভোগীদের সাথে কথা বলে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এখানে অভিযুক্ত ডেভেলপার কোম্পানিটিও রিহ্যাবের সদস্য নয়।

দৃশ্যপট: ১


সাবেক অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হাবিবুল্লাহ বাহার। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম বাঙ্গালী সেনা অফিসার, যিনি ভারতে চলে যান যুদ্ধ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য। কলকাতার আকাশ বাণী বেতারে সে খবর তখন প্রচার হয়। অবসরের পর পেনশনের টাকায় রাজধানীর মাটিকাটা এলাকায় ৫৭২ নং প্লটের মালিক হন তিনি। বহুতল ভবন নির্মাণের সামর্থ নেই তাঁর। ২০১৩ সালে রাইয়ান রিয়েল এস্টেট নামে একটি কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। ফিফটি ফিফটি হারে ফ্ল্যাটের মালিক হবেন দু’পক্ষ এমনটি কথা ছিল। বিকল্প বাড়ি ভাড়া হিসেবে ৫০ লাখ টাকা ডেভেলোপার কোম্পানি তাঁকে দিবে চুক্তিতে উল্লেখ আছে। ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়ার শেষ সময় নির্ধারিত হয় জুন ২০১৬। কিন্ত এখনো একটি ফ্ল্যাটও বুঝে পাননি প্লট মালিক হাবিবুল্লাহ বাহার। ৫০ লাখ টাকার সাইনিং মানির মধ্যে আগের ডেভেলোপারকে কিছু টাকা দিয়েছেন রাইয়ান রিয়েল এস্টেট এর মালিক মাওলানা মাশুক রেজা। কিন্ত তিনি এখনো প্লট মালিক হাবিবুল্লাহ বাহারকে কোনো টাকা দেননি। উপরন্ত ডেভেলোপার কোম্পানি তাঁর অংশের ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছে। সে ফ্ল্যাটে এখন ক্রেতা বসবাস করেন। অন্য একটি ফ্ল্যাটে ডেভেলোপার মাশুক রেজা হজ্বের অফিস খুলে বসেছেন। আর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল্লাহ বাহার রয়ে গেছেন তাঁর প্লটে নির্মিত ভবনের বাইরে। প্রাপ্য ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়া তো দূরে থাক, এখন ডেভেলোপার কোম্পানিটি বিভিন্নভাবে তাঁকে হয়রানি করছে।

এমন অভিযোগের কথা জানিয়ে ৭১ এর এ যোদ্ধা বলেন, ডেভেলোপার মাশুক তাঁর সাথে প্রতারণা করেছে। বিশ্বাস ভঙ্গ করে চাতুরতার মাধ্যমে তাঁর প্রাপ্য ফ্ল্যাটে ভাগ বসিয়েছে। আবার সাইনিং মানি না দিয়ে ধোঁকাবাজি করছে।

মিসেস বাহার পুরোনো দিনের স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু অনেক স্নেহ করতে তাঁর স্বামীকে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আজ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ডেভেলোপার মাশুকের মতো ধর্ম ব্যবাসায়ীরা এ ভাবে তাদের সাথে প্রতারণা করতে পারত না। এরা সমাজে বুক ফুলিয়ে চলতে পারত না। এক নি:শ্বাসে কথা গুলো শেষ করে মিসেস বাহার চশমার ফ্রেম খুলে আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন।

দৃশ্যপট-২
সৌদী প্রবাসী বেলায়েত হোসেন। দীর্ঘদিন থেকে চাকুরী সূত্রে সৌদী আরবে বসবাস করেন। বিয়ে করেন মাওলানা মাশুক রেজার ছোট বোন ইসরাত জাহান নাজমাকে। রাজধানীর ভাষানটেকে এক খন্ড জমি কেনার জন্য মাশুক রেজার হাতে তুলে দেন প্রায় ৩০ লাখ টাকা। ২০০৭ সালে বিদেশে কষ্টে উপার্জিত অর্থে কেনা হয় জমি। কিন্ত সে জমির দলিল করা হয় দু’টি। এর একটি বেলায়েত হোসেনের নামে আর অপরটি নিজের নামে করেনেন মাশুক রেজা। প্রবাসে থাকার কারণে প্রথমে তা বুঝতে পারেননি বেলায়েত হোসেন। আজও তিনি বুঝে পাননি জমির দখল। বেলায়েত হোসেনের টাকায় কেনা সে জিমিতে ফ্ল্যাট বিক্রির কথা বলে সাধারণ গ্রহকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় মাওলানা মাশুক রেজা। বেলায়েত হোসেন প্রতারণার অভিযোগ আনেন মাশুক রেজার বিরুদ্ধে। প্রতারণা কাজে সহযোগীতার অভিযোগ আনা হয় মাশুকের পিতা শামসুল হক, স্ত্রী ফারজানা আমিন ওরফে জেসি এবং ছোট ভাই মাছুম বিল্লার বিরুদ্ধে। পুলিশ লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর মাশুক রেজার পিতা শামসুল হককে আটক করে। বাকিরা এখন পলাতক অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

দৃশ্যপট:৩


রাজধানীর পূর্ব ভাষানটেক বাগানবাড়িতে নিজের ১২১/১ নং প্লটে যেতে পারছেন না ব্যবসায়ী মজিবুর রহমান। ভূয়া দলিল বানিয়ে রাতা রাতি প্লট মালিক বনে যান রাইয়ান রিয়েল এস্টেট এর মালিক মাওলানা মাশুক রেজা। নকল কাগজ দিয়ে রাজউক থেকে বহুতল ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদনও নেন তিনি। সন্ত্রাসীদের দিয়ে ভয় ভীতি দেখানো হয় মজিবুর রহমানকে। বাধ্য হয়ে আদালতের আশ্রয় নেন তিনি। আদালত ডেভেলোপার মাশুকের নির্মাণ কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সুপ্রীমকোর্টও এ নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখে। কিন্ত সর্বোচ্চ আদালতের এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাতের আঁধারে এক তলা ছাদ ঢালাই দেয় ডেভলোপার কোম্পানি। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা এবং সাইনবোর্ড লাগিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রি শুরু করে দেয় কোম্পানিটি। গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় মোটা অংকের অর্থ। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে এখন সেখানে নির্মাণ কাজ বন্ধ। ভাড়া দেয়া হয় গাড়ির গ্যারেজ হিসেবে। কথা হয় গ্যারেজের মালিক মাজহারের সাথে। সে জানায়, প্রায় সময় ফ্ল্যাট বুকিং দেয়া ব্যক্তিরা এখানে ভীড় জমান। ডেভলোপার মাশুক প্রতি মাসে চুপিসারে এখানে এসে গ্যারেজের ভাড়া নিয়ে যান তার কাছ থেকে।

প্লট মালিক মজিবুর রহমান জানান, মামলা কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। বৈধ মালিক হিসেবে রায় তাঁর পক্ষেই যাবে। এটা বুঝতে পেরে মাওলানা মাশুক রেজা তাঁকে চাঁদাবাজ সাজিয়ে থানায় জিডি করে আদালতে উপস্থাপন করেছে। মামলাকে ভিন্নখাতে নেওয়ার জন্য তাঁর এ অপচেষ্টা কোন কাজে আসবে না। এমন দৃঢ় আশাবাদের কথা জানালেন ভুক্তভোগী মজিবুর রহমান।

দৃশ্যপট:৪


রাজধানীর পুরান কচুক্ষেত বাজার এলাকায় অবস্থিত সিবি ২৭৩/৩ নং প্লটের মালিক শওকত আহমদ চৌধুরী। ২০১১ সালের জুন মাসে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন রাইয়ান রিয়েল এস্টেট এর সাথে। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়ার সময় শেষ হয়। কিন্তু সময় না বাড়িয়ে টালবাহানা করতে থাকে জমির মালিকের সাথে। ক্যান্টনম্যান্ট এলাকায় ভবন নির্মাণের জন্য বোর্ড কর্তৃক নিবন্ধন নেওয়া ডেভেলোপার কোম্পানির জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্ত রাইয়ান রিয়েল এষ্টেট কোম্পানি তা আমলে না নিয়ে অবৈধ ভাবে নির্মাণ কাজ করে যাচ্ছিল। ২০১৪ সালের ২৫ জুন ক্যান্টনম্যান্ট বোর্ড একটি চিঠি দেয়। যাতে বলা হয়, নিবন্ধন ছাড়া নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ অবৈধ। বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় হয় নির্মাণ কাজ। পরে ডেভেলোপার কোম্পানি ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন জমির মালিক ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে।

মামলায় চুরি এবং চাঁদবাজির অভিযোগ আনা হয়। পরে আদালত ওই মামলা খারিজ করে দেন। যখন চুরি এবং চাঁদাবাজির মামলা হালে পানি পায়নি। তখন ডেভলোপার মাশুক জমির মালিক ও তাঁর আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হত্যা চেষ্টা মামলা দায়ের করেন। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাতে গিয়ে নিজের এক কর্মচরী নির্মাণাধীন ভবনের সিঁড়ি থেকে পড়ে আহত হয়। এর দায় উল্টো চাপানো হয় জমির মালিকের ওপর।

অভিযোগ রয়েছে থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করা হয়। পরে ভিডিও ফুটেজে আসল তথ্য বের হয়ে আসে। মামলার তদন্ত ভার পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের ওপর। সে তদন্তে বেরিয়ে অঘটনের মূল হোতাদের নাম। এমন দাবি করে জমির মালিক বলেন, ডেভলোপাররা এতো খারাপ হয় জানলে তিনি কখনোই তাদের সাথে চুক্তি করতেন না। পাওনা বাড়ি ভাড়া আর ক্ষতিপূরণ তো দূরে থাক ডেভলোপারের সন্ত্রাসীরা এখন তাঁকে প্রতি নিয়ত হত্যার হুমকি দিচ্ছে।

জমির মালিক শওকত আহমদ চৌধুরী জানান, তাঁর স্বাক্ষর জাল করে মি: মাশুক গাড়ির স্টিকার সংগ্রহ করেন। আবেদন পত্রে তিনি শওকত আহমেদ চৌধুরীর ভোটার আইডি নম্বরে মিথ্য তথ্য দিয়েছেন। পরে কর্তৃপক্ষ গাড়ির স্টিকার বাতিল করেন এবং তাঁর কাছ থেকে স্টিকার জব্দ করেন। একই সঙ্গে রাইয়ান রিয়েলস্টেট কোম্পানিকে ওই এলাকায় কালোতালিকা ভুক্ত করে বিশেষ সর্তকতা জারি করেন। স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করে বোর্ড কর্তৃপক্ষ।

ডেভেলোপারের বক্তব্য:


উপরোক্ত এসব অভিযোগগের বিষয়ে রাইয়ান রিয়েল এস্টেট এর মালিক মাওলনা মাশুক রেজা অফিসে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। এমনকি তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। উল্টো ফোন কেটে দিয়েছেন। পরে আবার কল দেয়ার চেষ্টা করা হলে তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।