আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
বরিশালে পথশিশুদের স্বপ্নের আবাস

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এরাই নেতৃত্ব দেবে আগামীতে- হয়ে উঠবে আগামী দিনের কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, বৈজ্ঞানিক ইত্যাদি। তাই তাদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করা অত্যন্ত জরুরি। রাস্তায় জন্ম এবং রাস্তাতেই যারা বসবাস করে তাদের আমরা পথশিশু বলে থাকি। যে সকল শিশুর পিতা-মাতা নেই অথবা মা তালাকপ্রাপ্তা, বাবা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, মাদকাসক্ত কিংবা অসচ্ছল সে সব পরিবারের শিশুই পারিবারিক বন্ধন থেকে ছিটকে পড়ে। বাধ্য হয়েই এরা রাস্তায় নামে। রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, অফিস চত্বর, পার্ক ও খোলা আকাশের নিচে জীবনযাপন করার মাধ্যমে পরিচিতি পায় পথশিশু হিসেবে। জন্মের পর থেকেই পথশিশুরা জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। অন্য শিশুরা যখন বিদ্যালয়ে যায় লেখাপড়া করার জন্য- এরা নিজেদের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য খাদ্য অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকে।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার পথশিশু রয়েছে। সামিউল, মাহিন, স্বপন, আলম, পলাশ, কামরুল, শাহিন, জাভেদ, সুমন, আল আমিন, আতিক, সাইফুল- এমন কত নাম, কত শিশুদের। দূসর বর্তমানে দাঁড়িয়ে তারা প্রত্যেকেই রঙিন ভবিষ্যতের জাল বুনছে। সেই স্বপ্ন পুরনে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে একবার একটি লঞ্চে ওঠে পড়ে শাহিন। পৌঁছে যায় বরিশাল। সে লঞ্চ টার্মিনালেই বেশ কিছুদিন রাত্রিবাস। মাঝে এক বন্ধুর মাধ্যমে সে জানতে পারে বরিশাল সদরে অবস্থিত একটি আশ্রয়কেন্দ্রের সম্পর্কে। এর পর এক সন্ধ্যায় উপস্থিত হয় ‘জরুরি রাত্রিকালীন আশ্রয়কেন্দ্র’। এই আশ্রয়কেন্দ্রে পথশিশুদের রাতে থাকার পাশাপাশি তিনবেলা খাবরের ব্যবস্থা রয়েছে। পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় রেখে করা হয় পাঠদানও।

জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে বরিশাল সদরে ইউনিসেফের অর্থায়নে অপরাজেয় বাংলা নামের একটি সংগঠন এই আশ্রয়কেন্দ্রটি পরিচালনা করে আসছে। রোজ ৫০ থেকে ৬০টি পথশিশু এখানে রাত্রিযাপন করে।

আশ্রয়কেন্দ্রে কথা হয় শাহিনের সঙ্গে। মা-বাবার সূত্রে তার ঠিকানা জানতে চাইলে শাহিন সাংবাদিকদের বলে, কেরানিগঞ্জে একটা বাসস্ট্যান্ড আছে না, হেইডার কাছেই ছিল বাসা। সদরঘাটে বড় হইছি। উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে একবার একটি লঞ্চে ওঠে পড়ে শাহিন। পৌঁছে যায় বরিশালে।

স্বপ্ন ছাড়া বাঁচে কয়জন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে স্বপ্নকে পুঁজি করেই মানুষ বেঁচে থাকে। ওই কেন্দ্রেই শাহিনের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন সে জাতীয় স্মৃতিসৌধ আঁকছিল। বড় হয়ে কী হতে চাও? জানতে চাইলে পথে-পথে বেড়ে ওঠা শিশুটির দুচোখ স্বপ্নময় হয়ে ওঠে। বলে, পুলিশ হতে চাই। নেশাখোরদের ধইরা জেলে ঢুকাব। পুলিশের অনেক ক্ষমতা। পাশে বসে সবুজ জমিনে লাল সূর্যখচিত জাতীয় পতাকা আঁকছিল জাভেদ। সে বলে, আমি বড় হয়ে একটা লঞ্চের মালিক হতে চাই। কারণ? আনুমানিক ১০ বছর বয়সী এ বালকের ব্যাখ্যা, অনেক টাকা লাভ হয়। তখন আর ভাঙারি টোকাইতে হইবো না। টাকা থাকবো। আমি পড়ালেখা করব।

চাঁদপুর হয়ে লঞ্চে চড়ে তিন বছর আগে বরিশাল লঞ্চঘাটে নেমেছিল জাভেদ। বাড়ি নোয়াখালী। মা নেই। বাবা বিয়ে করে অন্যত্র থাকেন। বাবার সঙ্গে না থাকার কারণ জানতে চাইলে বলে, আমি মনে হয় বাবাকে চিনব না। বাবাও আমাকে চিনবে কিনা, জানি না। ছোটবেলায় কেমনে কেমনে যেন এইখানে চইলা আইছি।

দূসর বর্তমানে দাঁড়িয়ে তারা প্রত্যেকেই রঙিন ভবিষ্যতের জাল বুনছে। সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে সন্ধ্যার পর তারা আসে এ আশ্রয়কেন্দ্রে, তাদের স্বপ্নের আবাসে। রাতে তাদের বয়স ও মেধা বিবেচনায় পাঠদান করা হয়। পাশাপাশি খেলাধুলা ও নৈতিক শিক্ষারও ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।

আশ্রয়কেন্দ্রের ম্যানেজার গাজী শামছুল আরেফীন সাংবাদিকদের বলেন, ওদের পথশিশু বলা হয়। আসলে আমরাও ওদের ‘পথে’ আনতে চেষ্টা করি, সঠিক পথে। রাতে ওরা এখানে থাকার পাশাপাশি লেখাপড়ার সুবিধা পাচ্ছে। নয়তো রাস্তায় রাত্রিযাপন করতে হতো। তখন নেশা বা ছিনতাইসহ অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকত।

শামছুল আরেফীন আরও জানান, প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের পর যার-যার সামর্থ্য অনুসারে ওদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়। পাশাপাশি ওদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মা-বাবা যদি না-ও থাকে, স্বজনদেরও তো দায়িত্ব থাকে। আমাদের চেষ্টা থাকে পথের শিশুটিকে পরিবারে ফেরানো।