আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
মালয়েশিয়ায় ৩৬৫৬ বাংলাদেশির সেকেন্ড হোম- তদন্তে দুদক

২০০২ সালে মালয়েশিয়ায় মাই সেকেন্ড হোম নামে বিদেশিদের জন্য বাড়ি কিনে অভিবাসী হওয়ার সুযোগ দেয় মালয়েশিয়া। এরপর এ পর্যন্ত ৩৪ হাজারের বেশি বিদেশি এ প্রকল্পে অংশ নেন। যার মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। পনের বছরে মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় আবাস গড়েছেন ৩৬৫৬ জন বাংলাদেশি।তাদের কেউ কেউ ব্যবসায়িক কারণে সেখানে অবস্থানের জন্য দ্বিতীয় আবাস গড়লেও অনেকে অবৈধভাবে অর্থপাচার করে সেখানে বাড়ি কিনেছেন। যা দেশের প্রচলিত আইনে অপরাধ। এভাবে অর্থ পাচার করে বাড়ি কেনা ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী।

মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাড়ি কিনেছেন চীনের নাগরিকরা। এর পরের অবস্থানে জাপান। দ্বিতীয় আবাস বা সেকেন্ড হোম প্রকল্পে অংশ নেয়া বাংলাদেশিদের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। অর্থ পাচার করে বাড়ি কিনেছেন এমন সন্দেহভাজনদের একটি তালিকা করে তাদের বিষয়ে তদন্ত করতে একটি কমিটি করেছে দুদক। তদন্তের আওতায় আসা ব্যক্তির সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। তদন্তে অর্থ পাচারের বিষয় প্রমাণ হলে তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হবে।

মালয়েশিয়ার এম এম টু এইচ প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১৬৩ জন বাংলাদেশি সেকেন্ড হোমে বাড়ি করেছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মালয়েশিয়ায় যাতায়াতকারী ১০ হাজার ৯০৪ জনের তালিকা সংগ্রহ করেছে। এ তালিকা যাচাই বাছাই করে সেকেন্ড হোম প্রকল্পে অর্থ পাচার করতে পারেন এমন সন্দেহভাজন ১ হাজার ৫০ জনকে চিহ্নিত করা হয়। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত আরো ১৩ জনের তালিকা সংগ্রহ করেছে দুদক। তালিকায় নাম আসাদের মধ্যে ৬৪৮ জনের বিরুদ্ধে ৫ হাজার কোটি টাকা পাচারের প্রাথমিক প্রমাণও পাওয়া গেছে। আবার এদের মধ্য থেকে প্রাথমিকভাবে যাচাই বাছাই করে ২০ জনের একটি তালিকা নিয়ে পুরোদমে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, এই তালিকার মধ্যে সাবেক দুই এমপি, সাবেক এক বিচারক, সাবেক এক সচিব, বর্তমান সরকারের এক মন্ত্রীর ছেলে, বারভিডার সাবেক এক চেয়ারম্যান, চাঁদপুর জেলা বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের এক নেতা, বিএনপির সাবেক এক মন্ত্রী, সাবেক এক অর্থ মন্ত্রীর ছেলে, ফেনীর সরকারদলীয় এক এমপি, বিএনপির বাগেরহাটের সাবেক এক এমপি, বেসিক ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার নাম রয়েছে।

আবাসিক ভিসা নিয়ে বছরের পর ধরে মালয়েশিয়ায় আসা-যাওয়া করেন এমন ব্যক্তিদের তালিকা যাচাই-বাছাই ও তথ্য সংগ্রহে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। দুদকের উপ-পরিচালক মো. জুলফিকার আলী, সহকারী পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন ও উপ-সহকারী পরিচালক সরদার মঞ্জুর আহমেদ এই কমিটিতে রয়েছেন। কমিটির সদস্যরা ইতিমধ্যে ১ হাজার ৫০ জনের স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা, পাসপোর্টের ধরন ও সাংকেতিক বর্ণমালার ব্যাখ্যাসহ তথ্য প্রদানের জন্য দুদক থেকে পাসপোর্ট অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছেন। ওই চিঠিতে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়ার নামে অর্থ পাচারের অভিযোগ উল্লেখ করে সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে রেকর্ডপত্র ও তথ্যাদি পর্যালোচনা বিশেষভাবে প্রয়োজন উল্লেখ করা হয়। চিঠির সঙ্গে ১ হাজার ৫০ জনের নাম ও তাদের পাসপোর্ট নম্বর উল্লেখ করে আলাদা একটি তালিকা পাসপোর্ট অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া কিছু তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও একটি চিঠি দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভংকর সাহা জানান, অনেকে মালয়েশিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য করে সেখানে বাড়ি তৈরি করে। সে বিষয়ে তেমন কিছু করার নাই। তবে দেশের টাকা দিয়ে যদি কেউ দেশের বাইরে বাড়ি করে তবে সেটি মানি লন্ডারিংয়ের শামিল। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তদারকি করে থাকে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক মো. মাইদুল ইসলাম বলেন, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে এখন পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। তবে কমিশনের একটি তদন্ত দল এসব বিষয়ে তদন্ত করছে। মামলা হওয়ার পর সেটা আমার কাছে আসবে। ২০০২ সালে মালয়েশিয়ায় মাই সেকেন্ড হোম (এমএম২এইচ) প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন দেশ থেকে এখন পর্যন্ত ৩৪ হাজার ৫৯১ জন অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে শীর্ষ স্থানে চীনের ৯ হাজার ২৮৩ জন মালয়েশিয়ায় বাড়ি কিনেছেন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা জাপানের ৪ হাজার ৩০৩ জন এই সুবিধা নিয়েছেন। এছাড়া আয়ারল্যান্ডের ২ হাজার ৪৬৫, কোরিয়ার ১ হাজার ৪০৪, ইরানের ১ হাজার ৩৪১, সিঙ্গাপুরের ১ হাজার ৩২৫, তাইওয়ানের ১ হাজার ২৩৯, পাকিস্তানের ৯৮৩ ও ভারতের ৯১৫ জন এ প্রকল্পে অংশ নিয়েছেন।

মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম (এমএম২এইচ)-এর ওয়েব সাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশিরা এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ শুরু করে। ওই বছর মাত্র ৩২ জন বাংলাদেশি এতে অংশ নেয়। ২০০৪ সালে ২০৪, ২০০৫ সালে ৮৫২, ২০০৬ সালে ৩৪১, ২০০৭ সালে ১৪৯, ২০০৮ সালে ৬৮, ২০০৯ সালে ৮৬, ২০১০ সালে ৭৪, ২০১১ সালে ২৭৬, ২০১২ সালে ৩৮৮, ২০১৩ সালে ২৮৫, ২০১৪ সালে ২৫০, ২০১৫ সালে ২০৫, ২০১৬ সালে ২৮৩ ও ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত ১৬৩ জনসহ মোট ৩ হাজার ৬৫৬ বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় বাড়ি ক্রয় করেছেন।

এমএম২এইচের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস কর্মসূচির আবেদন করার আগে ন্যূনতম কিছু আর্থিক শর্ত পূরণের বিধান রয়েছে। পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের সাড়ে ৩ লাখ নগদ এবং দেড় লাখ মালয়েশীয় রিঙ্গিতের স্থায়ী আমানত থাকতে হবে। ওই বয়সের লোকজনের মাসিক আয় হতে হবে ১০ হাজার মালয়েশীয় রিঙ্গিত। ৫০ বছরের নিচে এই হার যথাক্রমে ৫ লাখ, ৩ লাখ ও ১০ হাজার মালয়েশীয় রিঙ্গিত। পঞ্চাশোর্ধ্ব সরকারি অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্য স্থায়ী আমানতের কোনো বিধান নেই। তবে এই শ্রেণির লোকজনের নগদ সাড়ে ৩ লাখ এবং মাসে ১০ হাজার মালয়েশীয় রিঙ্গিত আয় করতে হবে। পঞ্চাশোর্ধ্ব বা পঞ্চাশের নিচে যাঁদের ১০ লাখ মালয়েশীয় রিঙ্গিত সমমূল্যের বাড়ি থাকবে, তাঁদের ক্ষেত্রে কিছু ছাড় আছে। পঞ্চাশের নিচের বয়সীদের সাড়ে ৩ লাখ এবং স্থায়ী আমানত দেড় লাখ থাকলেই চলবে। তবে তাঁদের মাসিক আয় ১০ হাজার মালয়েশীয় রিঙ্গিত হতে হবে। আর পঞ্চাশোর্ধ্ব নগদ সাড়ে ৩ লাখ এবং ১ লাখ মালয়েশীয় রিঙ্গিত স্থায়ী আমানত থাকতে হবে। তাঁদের ক্ষেত্রে মাসিক আয় ১০ হাজার মালয়েশীয় রিঙ্গিত হতে হবে। তবে প্রার্থীর আবেদন প্রাথমিকভাবে অনুমোদনের নির্ধারিত সময়ের পর তাঁরা স্থায়ী আমানতের একাংশ তুলে নিতে পারবেন।

এই সুবিধা পেতে হলে একজন ব্যক্তিকে ৭ হাজার, স্বামী-স্ত্রীর জন্য সাড়ে ৭ হাজার এবং একটি পরিবারের জন্য ৮ হাজার মালয়েশীয় রিঙ্গিত ফি দিতে হয়। এখানে বলে রাখা ভালো, পরিবার বলতে স্বামী ও স্ত্রী ছাড়া তাঁদের দুজনের সন্তানকে নিয়ে একটি পরিবার বিবেচনা করা হয়। পরিবারের সদস্য এর চেয়ে বেশি হলে প্রতিটি সন্তানের জন্য বাড়তি আড়াই শ মালয়েশীয় রিঙ্গিত ফি দিতে হয়।