সাধারণভাবে বাংলাদেশে জমি বিক্রির আগে দীর্ঘ মেয়াদী বায়নানামা করা হয়ে থাকে। জমির বায়না করার আগেই এসব কাগজ দেখে নিতে হবে। তবে বর্তমান আইনে জমির বায়না রেজিষ্ট্রি করে নেওয়া বাধ্যতামূলক। জমির বায়না রেজিষ্ট্রি করলে নানা ধরনের ঝামেলামুক্ত থাকতে পারেন। সরকারী ষ্ট্যাম্পে বায়না করার যে নিয়ম প্রচারিত আছে তা না করে রেজিষ্ট্রিমূলে বায়না করা নিরাপদ।
আপনার জমি যে দলিলে লেখক লিখবেন তাঁর দায়িত্ব হবে জমির সব কাগজপত্র পরীক্ষা করা। তিনি ঠিকভাবে কাগজপত্র পরীক্ষা করছেন কি না তা মিলিয়ে দেখুন।
কাগজপত্র পরীক্ষা :
ক্রেতা যার কাছ থেকে জমি কিনবেন তার থেকে ওই জমি-সংক্রান্ত সব কাগজপত্র চেয়ে নেবেন। জমির সব খতিয়ানসহ (সিএস, আরএস, এসএ ও বিএস খতিয়ান) জমিটি যতবার বেচাকেনা হয়েছে, তার দলিলসমূহ চেয়ে নেবেন। এগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখবেন, বর্তমানে জমির মালিক কে।
নামজারি :
জমির যিনি মালিক, তার নামে নামজারি (মিউটেশন) আছে কি না তা নিশ্চিত হতে হবে। যে এলাকায় জমি কিনছেন ওই এলাকার স্থানীয় সহকারী ভূমি কমিশনার অফিসে গিয়ে খোঁজ নিলে নিশ্চিত হওয়া যাবে জমির বর্তমান মালিক কে। যদি দেখা যায় সব কাগজ ঠিক আছে -নামজারি না হয়ে থাকলে কেনার আগে বিক্রেতাকে বলুন তার নামে নামজারি করিয়ে নিতে।
খাজনা :
মালিক হালনাগাদ খাজনা (ভূমিকর) পরিশোধ করেছেন কি না, নাকি অন্য কেউ পরিশোধ করেন, তা-ও স্থানীয় তহশিল অফিসে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে। খাজনা পরিশোধের কাগজপত্র এনে ভবিষ্যতের জন্য ক্রেতার সংগ্রহে রাখতে হবে।
সাব-রিজিস্ট্রি অফিসে তল্লাশি :
ক্রেতা স্থানীয় সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে তল্লাশি দিয়ে দেখবেন প্রস্তাবিত জমি হেবা, দান, বিক্রি বা এওয়াজমূলে কোনোভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে কি না। জেলা সাব রেজিস্টারের অফিস থেকে ১২ বছরের তল্লাশী সহ নির্দায় সার্টিফিকেট (এন.ই.সি.) দেখে নিতে হবে। এ সনদে সর্বশেষ মালিকের নাম থাকে।
ফারায়েজ বা হিস্যাবন্টন :
বিক্রেতার শরিকদের সঙ্গে সম্পত্তির হিস্যাবন্টন সতর্কতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে। শরিকদের সঙ্গে বিক্রেতার অংশনামা হয়েছে কি না, তা জমি কেনার আগে মিলিয়ে দেখতে হবে। ফারায়েজ অনুযায়ী, বিক্রেতা যেটুকু জমির মালিক, তার বেশি কেনা ঠিক হবে না। অনেক সময় দেখা যায় বিক্রেতা পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমি বিক্রি করছেন।
নোটিশ :
জমি বায়না করার আগে আইনের বিধানমতে সব অংশীদারকে নোটিশ দিতে হবে। অন্যথায় পরবর্তীকালে অগ্রক্রয় বা প্রিয়েমশন মামলা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
পরিত্যক্ত কি না তা পরীক্ষা করতে হবে :
ক্রেতা যে জমি কিনবেন তা খাস, পরিত্যক্ত বা শক্রসম্পত্তি কি না, তা জানতে হবে। সঙ্গে এ ও জানতে হবে সরকার কোনো কারণে এ জমিটি অধিগ্রহণ করেছে কি না। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসন (ভূমি) অফিসে খোঁজ নিলে এগুলো জানা যাবে।
বন্ধক ক্ষমতা অর্পন করা আছে কি না:
জমি বিক্রি ও রক্ষণাবেক্ষনের জন্য কাউকে ক্ষমতা অর্পণ করা অর্থাৎ আমমোক্তারনামা (পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি) আছে কি না, তা দেখতে হবে। এমনকি জমি বন্ধক রেখে কোনো ব্যাংক বা অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া আছে কি না সে সম্পর্কে খোজ খবর নিতে হবে।
সরেজমিনে জমি দেখা :
সরেজমিনে গিয়ে ক্রেতাকে জমি দেখতে হবে। জমির কাগজপত্র, দাগ নম্বর ও চৌহদ্দি (চারদিকের অবস্থান) মিলিয়ে দেখতে হবে যে জমি বিক্রি করবে, সেটিই প্রস্তাবিত জমি কি না। জমির চারদিকের সীমানার মালিকদের সঙ্গে প্রয়োজনে কথা বলে নিশ্চিত হতে পারেন আপনাকে যে জমি দেখানো হয়েছে তার প্রকৃত মালিক কে। নাকি দালালেরা অন্যের জমি ক্রেতাকে দখল দিতে যাচ্ছেন। বিক্রির জন্য প্রস্তাবিত জমি বর্তমানে কার দখলে আছে, ক্রয় করলে কোনো কারণে ভোগদখলে বাধাগ্রস্ত হবে কি না বা রাস্তা ও পথ অধিকারে কোনো বাধা-নিষেধ আছে কি না, তা ও ক্রেতাকে সরেজমিনে যাচাই করতে হবে।
বিক্রির অধিকার বিক্রেতার আছে কি না :
বিক্রেতার মালিকানা স্বত্ব বা বিক্রির বৈধ অধিকার আছে কি না, তা দেখতে হবে। জমির মালিক নাবালক বা অপ্রকৃতস্থ কি না, তা ও যাচাই করতে হবে। নাবালক হলে আদালতের মাধ্যমে অভিভাবক নিযুক্ত করে জমি বিক্রির অনুমতি নিতে হবে। বিক্রেতা ওই অনুমতি নিয়েছেন কি না, তা-ও পরীক্ষা করে জমি কিনতে হবে।
মামলা মোকদ্দমা :
প্রস্তাবিত জমি নিয়ে কোনো মামলা-মোকদ্দমা রয়েছে কি না, তা-ও ক্রেতাকে খুঁজে দেখতে হবে। কারণ, মামলা মোকদ্দমা থাকলে জমি কেনা হলে তা হবে অন্যন- ঝুঁকিপূর্ণ। পত্রিকায় আইনগত বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কয়েকদিন সময় দিয়ে জমি ক্রয় করা উচিত। এতে জমির মালিকানা কেউ দাবি করলে কেনার আগেই তা করতে পারে। ফলে অবাঞ্ছিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতে পারে।
> নামজারি-জমা খারিজ: অন্তর্বর্তীকালীন রেকর্ড পরিবর্তন, সংশোধ ও হালনাগাদ প্রক্রিয়া নামজারি ও জমাখারিজ নামে আখ্যায়িত। যেহেতু জরিপকাজ দীর্ঘ ২৪/২৫ বছর পর সম্পন্ন হয়, অতএব এ সময়ের মধ্যে যদি মালিকানা পরিবর্তন হয় তবে সে পরিবর্তন যাতে সরকারি অফিসে রক্ষিত খতিয়ানে যথাযথভাবে লেখা থাকে সেজন্য নামজারির বিধান রাখা হয়েছে। সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে গিয়ে নামজারি বা মিউটেশন করিয়ে নেয়া। মিউটেশন না হলে জমির খাজনাও দেয়া যায় না।
>লক্ষ্য রাখতে হয় : জরিপ কখন হয়েছে, জমির নকশা কোথায় থেকে তোলা যায়, নিজের জমি অন্যের নামে জরিপে উঠে গেলে কোথায় মামলা করতে হয়।
>খতিয়ান রক্ষণাবেক্ষণ : জেলা প্রশাসকের রেকর্ডরুমে নতুন প্রাপ্ত খতিয়ান রক্ষনাবেক্ষন করা হয়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে, খতিয়ানের জন্য কালেক্টরের কাছে আবেদন করবেন। এর আলোকে রেকর্ড রুমের ভারপাপ্ত কর্মকর্তা সহিমুহুরি নকল সরবরাহ করবেন।
>জরিপ এর পর জরিপ বিভাগ কাজ সমাপ্ত করার পর খতিয়ানের একটা কপি জেলা জজের কাছেও হস্তান্তর করেন। এই খতিয়ানের আলোকে কোন ব্যক্তি যদি দেখেন যে তার জমি অন্যের নামে রেকর্ড হয়েছে তবে তিনি সহকারী জজ আদালতে সিভিল স্যুট (দেওয়ানি মামলা) দায়ের করেন।
> মৌজার নকশা ছাড়া খতিয়ান অর্থহীন : তেজগাঁওয়ে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে আবেদন করে নির্দিষ্ট ফি’র বিনিময়ে যে কোন নকশার ফটোকপি নিতে পারেন। যেসব মৌজার চূড়ান্ত- প্রকাশনা সমাপ্ত হয়েছে সেসব নকশার ফটোকপি এর কার্যালয় থেকে সংগ্রহ করা যায়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকেও তা সংগ্রহ করা যায়।
সবকিছু ঠিকঠাক পাওয়া গেলে জমি ক্রয় করা যেতে পারে। তবে উপরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কাজ ক্রেতা নিজে সম্পন্ন করতে না পারলে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে তা করা যেতে পারে। ক্রেতা দেওয়ানী আইনে অভিজ্ঞ কোনো আইনজীবির পরামর্শ ও মতামত নিয়ে জমি রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন করতে পারেন।