
নাগরিকদের সুন্দর ও মনোরোম আবাসনের ব্যবস্থা এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরির সংকল্প নিয়ে এগিয়ে চললেও একটা পর্যায়ে এসে নানা ধরনের সমস্যায় ধাক্কা লাগে আবাসন সেক্টরে। বিশেষ করে ওয়ান ইলেভেনের সময় ব্যবসায়ীদের হয়রানি করার কারণে এই সেক্টরে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে গৃহনির্মাণ খাতে স্বল্প এবং মধ্যবিত্তদের জন্য নির্ধারিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘূর্ণ্যয়মান হাউজিং লোন বন্ধ হয়ে গেলে বড় রকমের ধাক্কা আসে আবাসন খাতে। এছাড়া, শেয়ার বাজারে বিপর্যয়, উচ্চ সুদ হার এবং ক্রেতা পর্যায়ে ঋণের অভাব, জমির মূল্যের উর্ধ্বগতি, জমির মালিকের উচ্চ চাপ (চাহিদা), সাইনিং মানির দৌরাত্ত, সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যের উর্ধ্বগতি, উচ্চমাত্রার ব্যাংক ঋণের সূদের হার এবং সর্বোপরি ভবনের নকশা অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে আবাসন খাত মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়। রেজিস্ট্রেশন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সর্বত্রই ফ্ল্যাট ও জমি বিক্রি হ্রাস পেয়েছে। আবাসন ছাড়া নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবনযাপন অসম্ভব বিধায় সাধারণ মানুষের জন্যই আবাসন খাতের ঘুরে দাঁড়ানো খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে।
এমতাবস্থায়, বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় এই আবাসন শিল্প রক্ষার জন্য সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেছে রিয়েল এস্টেট এ্যান্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে রিহ্যাবের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী (শাওন) লিখিত বক্তব্যে উক্ত সংকট সমাধানে সরকারের কাছে আন্তরিকভাবে এ সহায়তা কামনা করেন। তিনি বলেন, আবাসন শিল্পের সংকট হতে উত্তরণের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর সমাধান করা খুবই অতীব জরুরি।
১. বর্তমানে বাংলাদেশের রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত ব্যয় ১৫.৫%। এরমধ্যে গেইন ট্যাক্স ৪%, স্ট্যাম্প ডিউটি ৩%, রেজিস্ট্রেশন ফি ২%, স্থানীয় সরকার কর ২% এবং ভ্যাট ৪.৫% (১.৫% থেকে ৪.৫%)। অন্যান্য সার্কভুক্ত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের রেজিস্ট্রেশন ব্যয় অতি উচ্চ। এই রেজিস্ট্রেশন ব্যয় ৬.৫% এ কমিয়ে আনা জরুরি। রেজিস্ট্রেশন ব্যয় কমিয়ে নিয়ে আসলে নাগরিকরা সঠিক দলিল মূল্য দেখাতে আগ্রহী হবে। ফলে রাজস্ব আয় আরো বাড়বে।
২. আমাদের দেশের ফ্ল্যাটের সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থা নেই। সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠলে নতুন একটা পেশাজীবি গড়ে উঠবে। এই সেক্টরে কর্মচাঞ্চল্য তৈরি হবে। সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থার প্রচলন একদিকে যেমন এই শিল্পকে এগিয়ে নিবে তেমনি বাজারে অর্থের লেনদেনও বাড়বে। অন্যদিকে সরকারও তার রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে। এ বিষয়ে গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের বিষয়টা উল্লেখ করার মত। প্রথমবার গাড়ী রেজিস্ট্রেশনে যে ব্যয় হয় দ্বিতীয় বার বিক্রির ক্ষেত্রে বা পরবর্তীতে আবার বিক্রির ক্ষেত্রে এই রেজিস্ট্রেশন ব্যয় অনেক কম। গাড়ীর মত আমরা ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য এই ব্যবস্থা চাই। পুন: বিক্রয়ের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়াসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মত রেজিস্ট্রেশন খরচ সর্বমোট ৩% নির্ধারণ করে সেকেন্ডারি বাজার ব্যবস্থার প্রচলন করা এখন সময়ের দাবি।
৩. আবাসন শিল্প রক্ষার্থে অবিলম্বে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক রি-ফাইন্যান্সিং ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। বিগত ২০০৮-০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতায় আবাসন খাতে সিঙ্গেল ডিজিট সূদে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। যা এই খাতে ক্রেতাদের জন্য অনেক ফলপ্রসূ ভূমিকা রেখেছিল। অনেকে নিজের কিছু মূলধন নিয়ে প্রায় ভাড়ার টাকায় ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এই ঋণ সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে এই খাত সংকটের মধ্যে পতিত হয়। আমরা চাই, ক্রেতা সাধারণ চাহিদামত ঢাকা শহরের আশে-পাশে বা মিউনিসিপ্যাল এলাকার পার্শ্বে ১৫০০ বর্গফুট বা তার চেয়ে ছোট ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য ৫% সুদে ২০ থেকে ৩০ বছরের কিস্তিতে ঋণ দিলে ক্রেতা সাধারণ ভাড়া সমান কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করতে পারবে। এমতাবস্থায়, আবাসন খাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ২০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করে ৫% সূদে ৩০ বছর মেয়াদে দীর্ঘমেয়াদী রি-ফাইন্যান্সিং চালুকরণ অতীব জরুরি, যাতে মাসিক কিস্তি বাসা ভাড়ার সমান হয়। এছাড়া, প্রথম ক্রেতার জন্য নূন্যতম মাথা গোজার ঠাঁই হিসেবে ৫% সূদে হাউজিং লোন দেয়ার দাবি জানাই।
৪. বর্তমানে আবাসন খাত শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু শিল্প খাত হিসেবে স্বীকৃত হলেও শিল্প খাতের সুবিধা পাচ্ছে না আবাসন খাত। শিল্প সুবিধা প্রদানের জন্য এনবিআর সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
৫. ক্রেতা, জমির মালিক ও ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য অসমাপ্ত প্রকল্পগুলোতে বিশেষ ঋণের প্রচলন করতে হবে। বর্তমানে ফ্ল্যাট ক্রেতা, ভূমির মালিক ও ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান যে সংকটে পড়েছে তা থেকে সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া উত্তরণের কোন পথ নেই। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ নানাভাবে আইনগত জটিলতায় জড়িয়ে পড়বে। তাই এই বিষয়ে একটি বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন বলেন, আবাসন খাতে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং সকল ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সকল ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে রিহ্যাব সদস্য হওয়া বাধ্যতামূলক করে পরিপত্র জারি করেছে। আমরা সরকারের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। আমরা আশা করি, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে আগামীতে এই খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদীহিতা আরো বাড়বে।
পাঁচ দিনব্যাপী (২১-১৫ ডিসেম্বর) রিহ্যাব ফেয়ার-২০১৭ উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রিহ্যাব। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বৃহস্পতিবার এই ফেয়ারের উদ্বোধন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
রিহ্যাবের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী (শাওন) এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। এছাড়াও ছিলেন রিহ্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট (১ম) লিয়াকত আলী ভূইয়া, সহ সভাপতি (ফিন্যন্স) প্রকৌশলী সোহেল রানা, রিহ্যাবের পরিচালক ও ফেয়ার স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান মো. শাকিল কামাল চৌধুরী, পরিচালক কামাল মাহমুদসহ রিহ্যাবের বর্তমান ও সাবেক নেতৃবৃন্দ।
রিহ্যাবের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নুরুন্নবী চৌধুরী (শাওন) আরও বলেন, একটি সুন্দর, পরিকল্পিত ও আধুনিক বাসস্থান তৈরিতে গৃহঋণের অবদান অনস্বীকার্য। বর্তমান প্রেক্ষাপটে একজন নাগরিকের পক্ষে হাউজিং লোন ছাড়া ফ্ল্যাট বা প্লট ক্রয় করা প্রায় অসম্ভব। আমাদের এ বছরের মেলায় ১৩ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন। এই সকল প্রতিষ্ঠান গৃহায়ন ঋণ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। তাই মৌলিক চাহিদা বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে এই রিহ্যাব ফেয়ার ২০১৭ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক ছাদের নিচে ক্রেতাদের ফ্ল্যাট বা প্লটের ঋণ নেওয়ার পাশাপাশি আবাসন খাতের বিভিন্ন ঋণ সম্পর্কে জানার সুযোগ তৈরি করবে। যা আবাসন সেক্টরের জন্য ইতিবাচক এবং মানুষের মৌলিক অধিকার বাসস্থানের চাহিদা পূরণের সহায়ক হবে। তবে ক্রেতারা যাতে খুব সহজে এই ঋণ পেতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এই সেক্টরে যে স্থবিরতা চলছে তা কাটিয়ে ওঠতে সহায়তা করবে এই রিহ্যাব ফেয়ার-২০১৭। একই সাথে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে এই মেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। পরিশেষে, রিহ্যাব ফেয়ার-২০১৭ এর সার্বিক সাফল্য কামনা করছি।
সম্পাদনা: আরএ/এসকে/এমএন