আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
আবাসন সুবিধাসহ প্রশাসনে বেড়েছে গণপদোন্নতি

কয়েক দফা গণপদোন্নতি, গাড়ি ও আবাসন সুবিধা বৃদ্ধিসহ নানা রকম আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে প্রশাসন ক্যাডার। অন্যান্য ক্যাডারে পদোন্নতি হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা শূন্যপদের নিরিখেই হয়েছে। তবে শূন্যপদ না থাকা সত্ত্বেও ২০১৭ সালে প্রশাসন ক্যাডারের অতিরিক্ত, যুগ্ম ও উপসচিব পদে দফায় দফায় পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও হয়েছে। আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়লেও ভ্রাম্যমাণ আদালতের অপব্যবহার করে বারবার সমালোচিত হয়েছেন মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। ২৯ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদে ‘জনপ্রশাসনে বেড়েছে গণপদোন্নতি গাড়ি ও আবাসন সুবিধা’ শিরোনামে এ তথ্য জানা যায়। পাঠকদের জন্য নিউজটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

প্রথমবারের মতো এবার সার্বক্ষণিক গাড়ির সুবিধা পেয়েছেন উপসচিব স্তরের কর্মকর্তারা। কিন্তু উপসচিব সমমানের অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছেন। আর প্রভাবশালী কর্মকর্তারা দফায় দফায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও পেয়েছেন, যা নিয়ে তাদের অধীনন্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। গাড়ির পাশাপাশি উপসচিবরা বাড়ি করার জন্য সুদবিহীন ব্যাংক ঋণও পাচ্ছেন।

সরকারের একজন সাবেক সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যে কোন পদোন্নতির পরপর কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা, গাড়ি ও আবাসন, দাপ্তরিকসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি পায়। অতীতে শূন্যপদের নিরিখে কর্মকর্তাদের পদায়ন দেয়া হতো। এই রেওয়াজ ভেঙে এই মহাজোট সরকারের আমল থেকে গণহারে পদোন্নতির প্রচলন শুরু হয়। এর ফলে সরকারের আর্থিক ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি নিচের পদে চাকরি করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কর্মকর্তারাও। কারণ, পদ না থাকায় অনেক কর্মকর্তাকেই নিচের পদে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। নিচের পদে দায়িত্ব পালন করেও ওইসব কর্মকর্তা ফের পদোন্নতি পাচ্ছেন। এতে তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়লেও সরকারের লাভবান হচ্ছে না।

এদিকে, সুযোগ-সুবিধা বাড়লেও মোবাইন কোর্টের (ভ্রাম্যমাণ আদালত) ক্ষমতার ব্যবহার-অপব্যবহার করে সমালোচিত হয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের মাঠপর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা, বিশেষ করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), সহকারী কমিশনাররা (ভূমি)।

গত ১২ ডিসেম্বর নিজ কক্ষে বসা নিয়ে বাগবিতণ্ডার জেরে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জ্যেষ্ঠ এক আইনজীবীকে সাজা দেওয়ার ঘটনায় ২৮ ডিসেম্বর উচ্চ আদালতে অনুতপ্ততা প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়ে পার পেয়েছেন কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারীর সহকারী কমিশনার (ভূমি) বিরোদা রানী রায়।

এর আগে গত ৩ ডিসেম্বর একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে লক্ষীপুরের সাবেক এক সিভিল সার্জনকে তিন মাসের সাজা দেয় জেলার এডিসি শেখ মুর্শিদুল ইসলাম এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুজ্জামান।

পরবর্তীতে এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় তাদের উচ্চ আদালতে তলব করা হয়। এতে এডিসি ও ইউএনও নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পার রক্ষা পান।

গাড়ি সুবিধা: জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত জুনে উপসচিবদের গাড়ির প্রাধিকার দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, সরকারের উপসচিবদের সার্বক্ষণিক সরকারি গাড়ি ব্যবহারের প্রাধিকার প্রদান করা হইল।

পরবর্তীতে ২৫ সেপ্টেম্বর ‘প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত বিশেষ অগ্রিম এবং গাড়িসেবা নগদায়ন নীতিমালা-২০১৭ (সংশোধিত) জারি করে সরকার। এই নীতিমালা অনুযায়ী, সরকারের সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিবদের মতো উপসচিবরাও গাড়ি সুবিধা পাচ্ছেন।

চাহিদা অনুযায়ী কোন কর্মকর্তাকে গাড়ি সুবিধা দেয়া সম্ভব না হলে ওই কর্মকর্তা গাড়ি কিনতে সরকারের কাছে সুদমুক্ত ঋণের জন্য আবেদন করবেন। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের গাড়ি কিনতে ৩০ লাখ টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেয়া হবে। এ ছাড়াও গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি, চালকদের বেতনসহ অন্য খরচ বাবদ প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা হারে বিশেষ ভাতা পাবেন উপসচিবরা।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে সরকারের উপসচিব আছেন ১ হাজার ৩৫৮ জন। তাদের প্রায় অর্ধেকই গাড়ি চেয়ে সরকারের যানবাহন অধিদপ্তরে আবেদন করেছেন। কিন্তু যানবাহন স্বল্পতায় তাদের গাড়ি বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, গত প্রায় আট বছর ধরে প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জন্য কোন নতুন গাড়ি কেনা হয়নি। তবে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য নিয়মিত গাড়ি কেন হয়।

উপসচিবদের অনুকূলে গাড়ি বরাদ্দ দিতে ৫০০টি নতুন গাড়ি কেনার জন্য প্রতিটির ব্যয় ৩৪ লাখ টাকা দরে ১৭০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রয়োজন। আর প্রায় এক হাজার উপসচিব গাড়ি কিনতে সুদমুক্ত ঋণের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এ ছাড়াও ভিআইপি বিশেষ করে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সমপদমর্যাদার ব্যক্তি ও বিদেশি অতিথিদের জন্য ৫টি বিএমডব্লিউ ও ৫টি মার্সিডিস গাড়ি কিনতে সাড়ে ১৫ কোটি টাকা এবং সচিবদের জন্য ৪৫টি সিডান কার কিনতে ২০ কোটি ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে অনুরোধ জানানো হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে। প্রতিটি বিএমডব্লিউ গাড়ির দাম প্রায় দেড় কোটি টাকা এবং মার্সিডিস ব্র্যান্ডের গাড়ির দাম ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।

সর্বশেষ জনপ্রশাসনে গত ২২ ডিসেম্বর ১৯৩ জন উপসচিব ও সমমর্যাদার কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্ম-সচিব করা হয়। এর আগে গত ১১ ডিসেম্বর প্রশাসনের ১২৮ জন যুগ্ম-সচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।

এছাড়া, গত ২৩ এপ্রিল ২৬৭ জন সিনিয়র সহকারী সচিবকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এর আগে সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর সরকারের অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম-সচিব ও উপসচিব এই তিন স্তরে পদোন্নতি পান ৫৩৬ জন কর্মকর্তা। সবমিলিয়ে বর্তমান সরকারের মেয়াদে পঞ্চম দফায় জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা বড় ধরনের পদোন্নতি পান।

এ ছাড়াও ২০১৬ সালের মে মাসে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম-সচিব ও উপসচিব পদে ২১৭ কর্মকর্তা এবং ২০১৫ সালের জুনে উপসচিব, যুগ্ম-সচিব এবং অতিরিক্ত সচিব পদে আরও ৮৭৩ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়।

জনপ্রশাসনের বর্তমান: জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গত ২৬ ডিসেম্বরের হিসেবে, বর্তমানে উপসচিবের নিয়মিত (ডিউটি) ৮৩৫টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ১ হাজার ৩৫৮ জন, যার মধ্যে ওএসডি আছেন ১১৯ জন।

যুগ্ম সচিবের ৪৩০টি স্থায়ী পদের বিপরীতে কর্মকর্তা আছেন ৮৪২ জন এবং অতিরিক্ত সচিবের ১১১টি স্থায়ী পদের বিপরীতে কর্মকর্তা আছেন ৫৫৮ জন। এর মধ্যে ওএসডি আছেন ২০৫ জন যুগ্ম-সচিব এবং ৩৮ জন অতিরিক্ত সচিব।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট জয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর থেকেই সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের দুই মেয়াদ গত প্রায় ৯ বছরে সরকারি প্রশাসনে সবচেয়ে বেশি পদোন্নতি পেয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। ৯ বছরে নিচের স্তরে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে শুরু করে উপরের স্তরে পর্যায়ক্রমে উপসচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন দুই হাজারেরও বেশি কর্মকর্তা। এরও উপরের স্তরে ‘বিশেষ’ সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি করা হয়।