আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
নির্মাণকাজ ও ভবন তৈরিতে পোড়া মাটির ইটের বিকল্প ভাবতে হবে

পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো পোড়া মাটির ইট প্রস্তুত থেকে অনেক আগেই সরে এসেছে। অথচ বাংলাদেশে ইটের বিকল্প ব্যবহার তো দূরের কথা, বিদ্যমান ইটভাটাগুলোর প্রায় ৪০ শতাংশই এখনো চলছে অবৈধ ফিক্সড চিমনি কিলন প্রযুক্তিতে। এতে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ। পরিবেশ দূষণ কমাতে হলে নির্মাণকাজে পোড়া মাটির ইটের বিকল্প উপকরণ ব্যবহার করতে হবে। গতকাল বণিক বার্তা ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

‘মাটি দিয়ে তৈরি পোড়ানো ইটের বিকল্প’ শীর্ষক এ গোলটেবিল আলোচনায় ইটের বিকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরই) পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাদেক। তিনি বলেন, বর্তমানে একটা পার্টিশন ওয়ালও আমরা ইট দিয়ে করছি। এটি ইট দিয়ে না করে কাচ, কাঠ বা অন্য কোনো জিনিস দিয়েও তৈরি করা যেতে পারে। উন্নত দেশে বিভিন্ন অবকাঠামোর পার্টিশন ওয়ালে সচরাচর শক্ত ইটের ব্যবহার করা হয় না। চাইলে আমরাও পার্টিশন ওয়ালে ইটের ব্যবহার থেকে সরে আসতে পারি।

দেশে ইটের বিকল্প সম্পর্কে এইচবিআরই পরিচালক বলেন, ইটের বিকল্প হিসেবে ‘হলো ব্লকের’ ব্যবহার দেশে সীমিত পরিসরে শুরু হয়েছে। ১৫-১৬টি প্রতিষ্ঠান এ ধরনের ব্লক উত্পাদন শুরু করেছে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, উত্পাদকরা বলছেন ক্রেতা পাচ্ছেন না। অন্যদিকে ক্রেতারা কোথায় এ ধরনের ব্লক বিক্রি হয় তা জানেন না। এটা একটা বড় ইস্যু। আবার অনেকেই ব্লকের প্রাপ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। অথচ একজন মানুষ ইচ্ছা করলেই বাড়িতে বসেই অল্প খরচে ‘হলো ব্লক’ বানাতে পারে। এছাড়া থার্মাল ব্লকসহ দেয়ালে আরো কিছু নির্মাণ উপকরণও ইটের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

অবকাঠামো নির্মাণে ইটের বিকল্প উপকরণ ব্যবহারের বিষয়টি ব্যাপক হারে প্রচার করা উচিত বলে মনে করেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (প্রশাসন-১ অধিশাখা) সুরাইয়া বেগম। তিনি বলেন, ইটের বিকল্প ব্যবহারের বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচারণার লক্ষ্যে যারা ভাটায় ইট উত্পাদন করছেন, তাদের নিয়ে বড় ধরনের কর্মশালা বা সেমিনার করা যেতে পারে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও ইটের বিকল্প সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে।

তিনি বলেন, মানুষকে সচেতন করে তোলার দায়িত্ব সরকার ও মন্ত্রণালয়ের। আমরা যদি মাটির পোড়া ইটের ব্যবহার থেকে সরে আসতে চাই, তাহলে বলামাত্রই কিন্তু মানুষ তা গ্রহণ করবে না। তারা ইটের বিকল্প উপকরণের মান, টেকসই যোগ্যতাসহ নানা প্রশ্ন তুলবে। তাদের এসব বিষয় অবহিত করার প্রধান দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। এরই মধ্যে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছে বলেও জানান তিনি।

অনুষ্ঠানে ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’-এর বিভিন্ন দিক ও সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) জিয়াউল হক। তিনি বলেন, আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ সময় তিনি সংশোধনের প্রক্রিয়াধীন আইনটির বিভিন্ন দিক উল্লেখ করেন।

ইটভাটায় যে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হয়, তা স্বীকার করছেন ইটভাটা মালিকরাও। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্রিক ম্যানুফ্যাকচারার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব আবু বকর বলেন, এটা শতভাগ সত্য যে, ইটভাটায় ব্যাপক হারে পরিবেশ দূষণ ঘটে। এজন্য অনেকে ইটভাটা বন্ধ করে দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে এটা ‘কথার কথা’ ছাড়া আর কিছুই নয়। ইটভাটা এভাবে বন্ধ হবে না। এর বিকল্প পণ্য যদি উত্পাদিত হয় এবং সরকার যদি সেটা ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা তৈরি করে, তবেই আপনাআপনি ইটভাটাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের আশঙ্কা, এ মুহূর্তে যদি ইটের বদলে ব্লক তৈরি শুরু করি, তাহলে ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নামবে। কারণ এখন যেসব প্রতিষ্ঠান ব্লক তৈরি করছে, তারাই সেগুলো ঠিকমতো বিক্রি করতে পারছে না।

বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘরে। এ অবস্থায় কীভাবে এই প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ওপরে নেয়া যায়, সে লক্ষ্যে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে। এই কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধির দিকে ধাবিত হতে হলে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের বিষয়টিও মাথায় রাখা জরুরি। কিন্তু আমরা উন্নয়নের কথা যেভাবে বলি, সেভাবে পরিবেশ, বায়ু ও পানির মান নিয়ে কথা বলি না। কিন্তু উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তাই পরিবেশের এসব ইস্যু নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছানো জরুরি। এক্ষেত্রে বেলার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। অন্যদিকে বণিক বার্তা অর্থনীতি বিষয়ক পত্রিকা হলেও পরিবেশ নিয়ে কয়েক বছর ধরে বড় পরিসরে কাজ করছে।

বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বর্তমানে দেশে বেসরকারিভাবে অপোড়ানো ইট প্রস্তুত শুরু হলেও তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। যথাযথ প্রণোদনা ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা না থাকা, সচেতনতা ও গ্রহণযোগ্যতার অভাব, সরকারি নির্মাণ প্রকল্পে অপোড়ানো ইট ব্যবহার না করা, ইমারত নির্মাণ আইন, বিধিমালা এবং ইটভাটাসংক্রান্ত আইনে অপোড়ানো ইটের উত্পাদন ও ব্যবহারসংক্রান্ত বিধান না থাকা, পেশাজীবীদের অনুত্সাহের কারণে বাড়ছে লাইসেন্সধারী ও লাইসেন্সবিহীন ইটভাটার সংখ্যা।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঞ্চালনায় গোলটেবিল আলোচনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ আজিজুল হক, ইসলামী ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) অধ্যাপক ড. তারেক উদ্দিন, ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের (আইএবি) সাবেক সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন, গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. আশিকুর রহমান জোয়ার্দার, অক্সফামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার খালিদ হোসেইন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ড. একেএম আবুল কালাম, জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর হাসান আরিফ, বিল্ডিং টেকনোলজিস অ্যান্ড আইডিয়াস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এফআর খান ও সয়েল রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল সায়েন্টিফিক অফিসার ড. আলতাফ হোসেন।