
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) আওতাধীন ‘পূর্বাচল নতুন শহর’ প্রকল্পে প্রাতিষ্ঠানিক প্লটগুলো গোপন টোকেনের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে বঞ্চিতরা। রাজউক প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দের স্বচ্ছতা নিয়ে বঞ্চিতদের মনে নানা প্রশ্ন উঠেছে। তাদের মতে, সম্প্রতি উত্তরা ১৮নং সেক্টরের উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের ‘এ’ ব্লকের হস্তান্তরযোগ্য ফ্ল্যাটের দ্বিতীয়বার ২৬২১ জনকে লটারির মাধ্যমে আইডি নম্বর প্রদান করেছে রাজউক। এসব ফ্ল্যাট বরাদ্দে লটারি হওয়ায় বঞ্চিত আবেদনকারীদের মধ্যে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব না থাকলেও ‘পূর্বাচল নতুন শহর’ প্রকল্পে প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দে রাজউকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিয়েছেন। রাজউক সূত্রে জানা যায়, ‘পূর্বাচল নতুন শহর’ প্রকল্পে প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দ পাওয়ার লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও রাজউকে কর্মরত কিছু কর্মকর্তার পছন্দের ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। সেখানে সাধারণ আবেদনকারীদের প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দ পাওয়াটা অসম্ভব। এছাড়াও দলের লেভেল, এমপি-মন্ত্রীর লোক কিংবা উৎকোচে মিলেছে এসব প্রাতিষ্ঠানিক প্লট। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজউক প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দ দেবে ৭৮টি। সেখানে আবেদনপত্র জমা পড়েছে প্রায় পাঁচশর উপর। দেখা যায়, এ ৫শ আবেদনপত্রের ভেতর এমপি-মন্ত্রী ও দলীয় লেভেল প্রাপ্ত লোকজন রয়েছে ২শ জন। সেখানে সাধারণ আবেদনপত্র বিবেচিত হবে ২শ জনের পর। ৭৮টি প্লট নিয়েই ২শ জনের ভেতরও চলে তুমুল প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় যাদের ‘ফেস’ পরিচিত রাজউকের বোর্ডসভার সদস্যরা তাদের এসব প্লট বরাদ্দ দিয়েছেন। সেখানে অসম্পূর্ণ ও ভুল আবেদনপত্র বাতিলের কোনো প্রশ্নই আসে না। রাজউকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে আমার সংবাদকে জানান, কোনো কোনো সময় প্লট বরাদ্দে রাজউকের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারাও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দেখা যায়, রাজউকের বোর্ডসভায় সদস্যরা প্লট বরাদ্দে একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন সেখানে ক্ষমতাসীন দলের ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা বা মন্ত্রী থেকে হঠাৎ ফোন আসে। তখন রাজউকের কর্মকর্তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। রাজউকের প্লট বরাদ্দের বিষয়টি নির্ভর করে অন্যের ওপর। অর্থাৎ রাজউকের বোর্ডসভার কর্মকর্তারাও কখনও প্লট বরাদ্দে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। ঠিক ‘পূর্বাচল নতুন শহর’ প্রকল্পের প্লট বরাদ্দে এমনটিই ঘটেছে বলে জানান এ কর্মকর্তা। প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দে একাধিক আবেদনকারী বলেন, রাজউক প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তি দেখে কতজন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছিলেন। সেখানে যারা প্লট পেয়েছেন আর যারা প্লট পাননি দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? এসব তথ্য রাজউকের ওয়েবসাইটে স্পষ্ট থাকলে প্রত্যেক আবেদনকারী সন্তুষ্ট থাকতে পারতেন। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। আমরা প্লট পাইনি, রাজউক দুবছর পর তা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, জামানতের টাকা উত্তোলনের জন্য। এতদিন ধরে আবেদনকারীদের কোটি কোটি টাকা রাজউকের অনুকূলে ফেলে রাখা হয়। যাদের অর্থ বিপুল তাদের অর্থ বছরের পর বছর রাজউকে পড়ে থাকলেও সমস্যা নেই। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ আবেদনকারীদের ১৫ লাখ টাকা রাজউকের অনুকূলে ২ বছর ফেলে রাখায় নিজেদের ক্ষতি হয়েছে। গরিবদের ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু’Ñ এ রকমই একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ৬ ক্যাটাগরিতে ১ বিঘা থেকে ৩ বিঘা পর্যন্ত জমি থাকছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর বেশিও থাকতে পারে। তবে এসব প্লট বরাদ্দ কমিটির মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। রাজউকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আবেদনকারী প্লট না পেলে জামানতের টাকা তুলে নেবেন, এটি স্বাভাবিক। একটি প্লটের জন্য শত শত আবেদন জমা পড়ে। সেখানে যারা প্লট পায়নি তাদের জামানতের টাকা তুলে নেওয়ার জন্য রাজউক থেকে সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। কেউ প্লট পায়নি জামানতের টাকা তুলে নিয়ে আবারো প্লটের জন্য আবেদন করতে পারবেন। রাজউকের সেকেন্ডারি স্কুলের জন্য বরাদ্দকৃত প্লট না পেয়ে শফিউল্লাহ (ছদ্ম নাম) এক ভুক্তভোগী আমার সংবাদকে বলেন, আমরা ক্ষুদ্র মানুষ, আমাদের কোনো উপায় নেই। ২০১৫ সালের বিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করে প্লট পাইনি। একই ক্যাটাগরিতে রাজউক আবারও বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। আবারও আবেদন করেছি। গতবার আবেদন করে প্লট না পেয়ে প্রায় ২ বছর পর টেবিলে টেবিলে ঘোরাঘুরি করে জামানতের টাকা তুলেছি। এবার কবে নাগাদ প্লট বরাদ্দের জন্য লটারি দেবে তাও জানি না। রাজউক আবেদনকারীদের টাকা নিয়ে বসে থাকে, তাদের কোনো সমস্যা নেই। যত সমস্যা আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষদের। ই-টোকেন নয়, হাতে হাতে টোকেনের ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক প্লটগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানান এ ভুক্তভোগী। রাজউকে জমা দেওয়া টাকা তোলাও কঠিনÑ এমন মন্তব্য করে শফিউল্লাহ আরও বলেন, আমি প্লট পাইনি, রাজউক আমার টাকা ব্যাংকে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু তা করেনি। নিজের জামানতের টাকা তুলতে রাজউকে দরখাস্ত করে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। রাজউকের চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের পর নিচ তলায় এভাবে প্রায় ১শ টেবিল ঘুরে জামানত তুলতে হয়েছে। জামানত তুলতে ব্যালেন্স সিট নিতে হয়। ব্যালেন্স সিট নিতেও গ্রাহকদের গুণতে হচ্ছে টাকা। প্লট না পেলে আবেদনের ৫ হাজার টাকা অফেরতযোগ্য থেকে যাচ্ছে। টাকা জমা দিতে একবার কষ্ট পেলাম। প্লট তো পেলামই না, এখন টাকা ফেরত নেওয়া দেখছি আরও কঠিন। এ ধরনের হাজারো আক্তারুজ্জামান রতন প্লট না পেয়ে জামানতের টাকা উত্তোলনের জন্য রাজউকের বারান্দায় বারান্দায় প্রতিনিয়ত ঘুরছেন। ঘুরছেন রাজউক ভবনের এ-তলা থেকে ও-তলায়, কিংবা টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাংকগুলোতে। এ ব্যাপারে রাজউকের সচিব সুশান্ত চাকমা আমার সংবাদকে বলেন, রাজউকের চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর দেখে আমি বিজ্ঞপ্তিতে স্বাক্ষর করেছি। এর বাইরে এসব প্রাতিষ্ঠানিক প্লট সম্পর্কে কিছু বলতে পারবো না। এ বিষয়ে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্য চাইলে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, রাজউকের যেকোনো তথ্য জানার জন্য রাজউক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমানের অনুমতি লাগবে। চেয়ারম্যানের অনুমতি ছাড়া মিডিয়ার সামনে বক্তব্য দেওয়া নিষেধ। চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ করুন। এব্যাপারে রাজউকের চেয়ারম্যানের দপ্তরে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম জানান, স্যার ব্যস্ত আছেন। উল্লেখ, ২০১১ ও ২০১৫ সালে ‘পূর্বাচল নতুন শহর’ প্রকল্পে ৬ ক্যাটাগরিতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয় রাজউক। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসের ১৬ তারিখে একই ক্যাটাগরিতে আবারও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয় রাজউক। এ ৬ ক্যাটাগরিতে রয়েছে নার্সারি (প্লে-গ্রুপ থেকে স্টান্ডার্ড-৫) প্লটের জন্য জামানত বাবদ ২০ লাখ টাকা রাজউকের অনুকূলে জমা দিতে হয়। এছাড়া প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি স্কুল, সেকেন্ডারি স্কুল, সেকেন্ডারি স্কুল ও কলেজ, কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ (ছাত্রাবাসবিহীন) ও হাসপাতালের প্লটের জন্য ১৫ লাখ টাকা করে আবেদনকারীকে রাজউকের অনুকূলে জামানত দিতে হয়।