
নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না সর্ববৃহৎ আবাসিক এলাকা পূর্বাচল নতুন শহর নির্মাণ প্রকল্প। বরং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর মেয়াদ আরো ২ বছর বাড়াতে চায়। যদিও চলতি বছরের জুনে ওই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সার্বিক অগ্রগতি বিবেচনায় ও স্মার্ট এবং আধুনিক সিটি হিসেবে পূর্বাচলকে গড়ে তুলতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ কোনভাবেই শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। সেজন্য প্রকল্প পরিচালকের পক্ষ থেকে আরো ২ বছর সময় চেয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছে। রাজউক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হলেও ভূমি উন্নয়ন কাজ শেষ না হওয়া, চলতি বছরের শুরুতে কিছু এলাকার কাজ শুরুর জন্য ওয়ার্কঅর্ডার দেয়া, উন্নয়ন কাজে স্থানীয় বাধা, পরিবেশবাদী সংগঠনের মামলা ও আদালত কর্তৃক উন্নয়ন কাজে স্থিতাবস্থা থাকাসহ নানা সমস্যা ও বাধার কারণেই মূলত নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। ওসব কারণে প্রকল্পটি শেষ করতে ৩ বছরের পর এবার নতুন করে আরো ২ বছর সময় বৃদ্ধির প্রস্তাব করছে রাজউক। কারণ আগামী জুন মাসে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত ভূমি উন্নয়নের কাজই শেষ হয়নি। আর প্রকল্প শুরুর পর গত ২৩ বছরে মোট ভূমি উন্নয়ন হয়েছে ৮২ শতাংশ। প্রকল্পের ধীর গতির কারণ হিসেবে রাজউকের অভিমত- আদালতের নিষেধাজ্ঞা এবং পরিসেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর অপারগতার কারণেই শত চেষ্টা করেও নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজউক ‘পূর্বাচল নতুন শহর’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে ঢাকা শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ স্বয়ংসম্পূর্ণ নতুন টাউনশিপ গড়ে তুলে ঢাকার ওপর আবাসন চাপ কমানো। প্রকল্পের আওতায় ৬ হাজার ২৭৭ দশমিক ৩৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তার মধ্যে নারায়ণগঞ্জ অংশে রয়েছে ৪ হাজার ৫৭৭ দশমিক ৩৬ একর এবং গাজীপুর অংশে ১৫শ’ একর জমি; যা ৩০টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। বাকি ১৫০ একর জমি ঢাকা জেলার খিলক্ষেত থানায় কুড়িল ফ্লাইওভার এবং লিংক রোড নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকল্পটিতে বিভিন্ন আকারের মোট ২৭ হাজার ১৭১টি প্লট এবং ৬২ হাজার এ্যাপার্টমেন্টের সুযোগ রয়েছে। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে থাকছে ৪৩ কি.মি লেক, যা আবাসিক এলাকার সর্ববৃহৎ লেক। তাছাড়া থাকছে ৬২টি ব্রিজ ও কালভার্ট। অভ্যন্তরীণ রাস্তা থাকছে ৩১৯ কি.মি। প্রকল্পটির সর্বশেষ সংশোধিত প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ হাজার ৭৮২ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা সম্পূর্ণ রাজউকের নিজস্ব অর্থ। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ধরা হয়েছিল। যা পরবর্তীতে সংশোধন করে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এখন ওই সময় আরো ২ বছর বৃদ্ধি করে ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত করার প্রস্তাব করছে রাজউক।
সূত্র আরো জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিভূত অগ্রগতির মধ্যে ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৫৮ শতাংশ। আর আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৩৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যা টাকার হিসেবে ২ হাজার ৮শ ৬০ কোটি টাকা। তাছাড়া গ্যাস, পানি ও পয়ঃ ব্যবস্থার মতো পরিসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো অপারগতা জানানোর পরে পিপিপি চুক্তি করা হয়। ওই চুক্তির আওতায় লিংক রোডের দুই পাশে খাল খনন ও উন্নয়ন পরবর্তী পর্যায়ে প্রকল্পের ব্যয়যোগ্য মূল্য দাঁড়ায় ৫ হাজার ৭শ ৫৩ কোটি টাকা। তার ভিত্তিতে প্রকল্পের বর্তমান অগ্রগতি দাঁড়ায় আর্থিক ৪৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং বাস্তবতা প্রায় ৬৮ শতাংশ। তাছাড়াও প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির মধ্যে রয়েছে কুড়িল ফ্লাইওভার নির্মাণ। প্রকল্পের ৩শ ১৯ কি.মি রাস্তার মধ্যে ইতিমধ্যে ১শ ৬০ কি.মি নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। পাশাপাশি প্রকল্পের ৬২টি ব্রিজের মধ্যে ৩৪টি নির্মিত হয়েছে। ৫টির কাজ চলমান রয়েছে এবং বাকি ১৫টি বিষয়ে কার্যাদেশ করা হয়েছে। প্রকল্পের ২৫ হাজার ১৬টি আবাসিক প্লটের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার প্লট ইতিমধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। ওসব প্লটে ২শটি ইমারতের নক্সা অনুমোদনপ্র্রদান করা হয়েছে এবং ইতিমধ্যে অনেকে কাজও শুরু করেছেন। তবে অভিযোগ রয়েছে ওই প্রকল্পে প্লটপ্রাপ্তরা পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। রাজউকের একশ্রেণীর কর্মচারী ও দালাল চক্র বিভিন্নভাবে প্লট মালিকদের ভোগান্তিতে ফেলে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের অর্থ। স্থানীয় অধিবাসীদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা না করেই প্রকল্পের প্লট বিতরণ ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ায় স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘাত লেগেই রয়েছে। ওসব সমস্যার মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলেছে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের উন্নয়ন কাজ।
এদিকে রাজউক থেকে সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। তাতে প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ও সময় বৃদ্ধির কারণ উল্লেখ করে প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯৩-৯৪ সাল হতে শুরু করে ২০টি এলএ কেসের মাধ্যমে দীর্ঘসময়ে প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ করা হয়। দীর্ঘ অধিগ্রহণ সংক্রান্ত কয়েকটি মামলায় আপীল বিভাগের রায়ের প্রেক্ষিতে অধিগ্রহণ সংক্রান্ত কার্যক্রম ২০১০ সালে সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে ওই বছরেই জরিপ কাজ শেষে করে ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হলেও স্থানীয়দের বাধার কারণে কাজটি শুরুই করা যায়নি। পরে কয়েক দফা চেষ্টা করে কাজ শুরু করা হলেও আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে প্রকল্প কাজে আশানুরূপ অগ্রগতি সম্ভব হয়নি। তাছাড়াও সুপ্রিমকোর্টের আপীল বিভাগ থেকে ৭টি পরিবেশবাদী সংগঠনের আবেদনের প্রেক্ষিতে সকল কাজ ও আর্থিক লেনদেনের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করলে দীর্ঘদিন যাবত কাজটি বন্ধ রাখা হয়। মূলত ১৯৯৫ সালে প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হলেও ২০০৩ সালে ঢাকা জেলার ১৫০ একর ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ৪ হাজার ৫০০ একর ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়। তারপর শুরু হয় ভূমি উন্নয়ন কাজ। কিন্তু স্থানীয়দের প্রবল বাধার কারণে ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ভূমি উন্নয়নের কাজ অত্যন্ত মন্থর হয়ে পড়ে। অতঃপর ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ অংশে স্থানীয় আদিবাসীদের মাঝে প্লট প্রদান করে স্থানীয় প্রতিরোধ কিছুটা প্রশমিত করা গেলেও দেশের তৎকালীন বিরাজমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণেও উচ্ছেদ কার্যক্রমে পুলিশ না পাওয়ায় উন্নয়ন কাজ বিলম্বিত হয়। অনাকাক্সিক্ষত কারণে উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নে ব্যাঘাত ঘটায় কাক্সিক্ষত অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব হয়নি বিধায় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত নতুন করে ২ বছর বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হচ্ছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের পরিচালক ও রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিক জানান, জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হলেও ভূমি উন্নয়ন কাজ সম্পূর্ণ শেষ না হওয়া, চলতি বছরের শুরুতে কিছু এলাকার কাজ শুরুর জন্য ওয়ার্কওর্ডার দেয়া, উন্নয়ন কাজে স্থানীয় বাধা, পরিবেশবাদী সংগঠনের মামলা ও আদালত কর্তৃক উন্নয়ন কাজে স্থিতাবস্থা থাকাসহ নানা সমস্যা ও বাধার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানা গেছে। ওসব কারণে প্রকল্পটি শেষ করতে ৩ বছরের পর এবার নতুন করে আরো ২ বছর সময় বৃদ্ধি করতে হবে। তাছাড়া আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহণের কারণে প্রকল্পের বেশকিছু স্থানে বাধার সৃষ্টি হয়। পরে কয়েক দফা তাদের সঙ্গে আলোচনা করে পুনরায় কাজ শুরু করতে কিছুটা সময় লেগে যায়। তাছাড়া গাজীপুর অংশের উন্নয়ন কাজ করার জন্য ইতিমধ্যে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই কাজ কোনভাবেই আগামী ৬ মাসের মধ্যে শেষ করা সম্ভব নয়। তাই পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আরো ২ বছর সময় বৃদ্ধির প্রস্তাব দ্রুততম সময়ের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।