
প্রতিটা নাগরিকের নিরাপদ আবাসন সুবিধা পাওয়ার অধিকার থাকলেও শহরের নারীদের ক্ষেত্রে তা সীমিত। বিশেষ করে যেসব নারী শহরে নিজের মতো করে একা থাকতে চান তাদের জন্য এ সুবিধা একেবারে নেই বললেই চলে। সামর্থ্য থাকলেও একজন নারী শিক্ষার্থী, কর্মী বা কর্মকর্তা পছন্দের আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন না। সামাজিক কারণে একজন নারী একাকী একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে পারছেন না। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কর্মজীবী নারীদের জন্য কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা মানহীন ও অনিরাপদ। এ কারণে নিরাপদ আবাসন শহরের নারীদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বসবাসের জন্য আবাসিক হল রয়েছে। তবে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। তারপরও সেই হলগুলোর পরিবেশ নিয়েও শিক্ষার্থীদের নানা অভিযোগ রয়েছে। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যূনতম একটা ব্যবস্থা থাকলেও দেশের ৯৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই। যে কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাড়তি ভাড়া দিয়ে কয়েকজন মিলিয়ে একসঙ্গে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাড়তি ব্যয়ের বোঝা বইতে হয়। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু ব্যক্তি মালিকানাধীন ‘ছাত্রী হোস্টেল’ গড়ে উঠেছে। সেখানেও একটি কক্ষে ছয়-সাতজনকে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। খাবারের মান, পরিবেশ আর নিরাপত্তা নিয়ে অভিযোগ বেশ পুরোনো।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করা এক ছাত্রী বলেন, ‘অবিবাহিত বলে বাসা ভাড়া পেতে বেশ বেগ পেতে হয়। পেলেও বাসার মান-পরিবেশ ভালো হয় না। টয়লেট থেকে শুরু করে রান্না করতে সমস্যায় পড়তে হয়। এছাড়া বাড়ির নিচতলার ফ্ল্যাটগুলোতে অবিবাহিতদের ভাড়া দেওয়া হয় না। অনেক সময় একই ভবনের অন্যদের তুলনায় মেয়েদের বাড়তি ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়। নারীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও সন্তোষজনক নয়।’
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন ফাতিমা। চাকরি পেয়েছেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ঢাকা কার্যালয়ে। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। তার পরিবারের কেউ নেই ঢাকায়। আকর্ষণীয় করপোরেট চাকরি পেয়েও এখন বিপাকে পড়েছেন থাকার জায়গা নিয়ে। সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে আসন সন্ধান করেছিলেন। মেলেনি। ফলে এখন থাকছেন মনিপুরিপাড়ার একটি ছাত্রী হোস্টেলে।
ফাতিমার মতো আবাসন সংকটে রাজধানীর লাখো কর্মজীবী নারী। করপোরেট প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সংস্থা, ব্যাংক কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত হাজারো ব্যাচেলর নারীর নিত্যদিনের সমস্যা এ আবাসন। এমনই একজন হচ্ছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রে কর্মরত সুবর্ণা ধর। পরিবার থাকে চট্টগ্রামে। এখনও বিয়ে করেননি। আলাপের সময় বলছিলেন, ‘ব্যাচেলর ছেলেদের জন্য মেস পাওয়া গেলেও ব্যাচেলর মেয়েদের বাসা ভাড়া পাওয়ার মতো কঠিন পরিস্থিতি আর নেই।’
একদিকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, অন্যদিকে পরিবারের নানা দুশ্চিন্তার কারণে এসব কর্মজীবী নারী থাকছেন নানা দুর্ভাবনায়। শিক্ষিত নারীদের পাশাপাশি অর্ধশিক্ষত শ্রমজীবী নারীদের আবাসনের সংকট আরও প্রকট। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন পোশাক কারখানায় কাজ করেন লক্ষাধিক কর্মজীবী নারী। মেশিন অপারেটর থেকে কোয়ালিটি কন্ট্রোল পর্যন্ত নানা ছোট-বড় কাজ করেন তারা। কিন্তু কর্মব্যস্ততার শেষে তাদের আশ্রয়ের জন্য ব্যবস্থা রয়েছে সামান্যই।
নারায়ণগঞ্জের রেমি হোল্ডিংস, প্লামি ফ্যাশনসসহ কিছু পোশাক কারখানা শ্রমিকদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করলেও রাজধানীর প্রতিষ্ঠানগুলোতে সে ব্যবস্থা নেই।
কর্মজীবী নারীদের সংকট আরও প্রকট। রাজধানীতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারী কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসনের ব্যবস্থা নেই। সরকারিভাবে রাজধানীতে তিনটি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল গড়ে তুলেছে মহিলাবিষয়ক অধিদফতর। তবে সেগুলোর মোট আসন সংখ্যা এক হাজারেরও কম। অথচ বেসরকারি একটি সংস্থার হিসেবে দেশজুড়ে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ। যাদের সিংহভাগ রাজধানীতে কর্মরত। যে কারণে স্বল্প আয়ের কর্মজীবী নারীদের ক্ষেত্রে বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা হোস্টেলগুলোই একমাত্র ভরসা। হোস্টেলের ঘিঞ্জি পরিবেশ, নিম্নমানের খাবার এড়িয়ে আরেকটু ভালোভাবে থাকতে কয়েকজন একত্র হয়ে ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকেন। সেক্ষেত্রে যন্ত্রণার শেষ নেই। নারীদের ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়ার জন্য বাড়তি ভাড়া নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের আদেশ-নির্দেশনা চাপিয়ে দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচালক গাজী মো. নূরুল কবির শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সমাজসেবা অধিদফতরের আলাদাভাবে নারীদের জন্য কোনো আবাসন ব্যবস্থা নেই। তবে বৃদ্ধ ও শিশুদের জন্য কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারীদের আবাসনের জন্য কিছু উদ্যোগ রয়েছে।’
আলাপকালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শারমিন জাহান বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সময় থেকে প্রায় এক যুগ ধরে এ শহরে আছি। পরিবারের বাইরে একা থাকার কারণে শুরু থেকেই নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। এক সময় বেসররকারি ছাত্রী হোস্টেলে ছিলাম। সেখানে ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যেই থাকতে হয়েছে। তারপর কিছুদিন কয়েজন একসঙ্গে ফ্ল্যাট নিয়েছিলাম। এই শহরে একা থাকা মানে পদে পদে ভোগান্তি-বিড়ম্বনা। মূল বিষয় হচ্ছে, নারীদের আবাসনের বিষয়ে সরকারি পদক্ষেপ নেই। বেসরকারি পদক্ষেপও অপ্রতুল। কেউ কেউ শুধু বাণিজ্যিক চিন্তা মাথায় রেখে আবাসনের ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু নারীদের আবাসনের অধিকারের দিকটি মাথায় রাখা হচ্ছে না। সে কারণেই সংকট প্রকট হচ্ছে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী নারীরা কোনো রকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেও একা থাকার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়। এ নিয়ে বিদ্রƒপ-কটূক্তির মুখে পড়তে হয়। আবাসন ব্যবস্থার এ সংকটের কারণে মূলত ইচ্ছা ও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অনেক নারী রাজধানীতে এসে কর্মস্থলে যোগ দিতে পারছেন না। অনেকে রাজধানীতে এলেও আবাসন নিয়ে ঝক্কির কারণে কাজে মনোনিবেশ করতে পারছেন না। সমাজের অগ্রযাত্রায় নারীরা ভূমিকা রাখলেও তাদের আবাসনের অধিকার নিশ্চিত করতে সামাজিকভাবে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসাইন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের নারীদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য তাকে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা থেকে বের করতে হবে। সেজন্য অর্থনৈতিকভাবে তার ক্ষমতায়নও জরুরি। এখন নারীকে কর্মসংস্থানে সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি তার পরিবহন, বিনোদন ও আবাসনের ব্যবস্থা যদি না করা যায় তাহলে মূল উদ্দেশ্য হাসিল হবে না।’