আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
আবাসন করার নামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘সবুজহারা’ করার উদ্যোগ

জীববৈচিত্র্যপূর্ণ সবুজ ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘সবুজহারা’ করার উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নানা জাতের উদ্ভিদে আচ্ছাদিত প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্যাম্পাসে নতুন করে ২৩টি বহুতল ভবন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়নের জন্য এসংক্রান্ত একটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধা, একাডেমিক, প্রশাসনিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য এসব ভবন নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে। প্রস্তাবিত ২৩টি ভবনের মধ্যে ১৭টিই ১০ তলা, চারটি ছয়তলা, একটি সাততলা এবং একটি তিনতলার। এর মধ্যে ছাত্রদের থাকার জন্য তিনটি ১০ তলা হল, ছাত্রীদের জন্য তিনটি ১০ তলা হল করা হবে। বাকিগুলো প্রশাসনিক ভবন এবং হাউস টিউটর, প্রভোস্ট, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের ভবন। এ ছাড়া একটি গেস্ট হাউস-কাম পোস্টগ্র্যাজুয়েট রিসার্চার হাউস নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছ এক হাজার ২০৮ কোটি টাকা। এই পুরো টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে পাওয়ার আশা করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে এত বড় একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হলো, অথচ কোনো ধরনের সমীক্ষা করা হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর কোনো ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে কি না, সে বিষয়েও সমীক্ষা হয়নি। বিস্তারিত সমীক্ষা না করেই প্রকল্পটি পাঠানো হয়েছে।

কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, দেশে এবং দেশের বাইরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে মানুষ চেনে ও জানে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের ক্যাম্পাস হিসেবে। সেখানে বহুতল ভবন নির্মিত হলে সবুজ ক্যাম্পাস রূপ পাবে কংক্রিটে।

পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধান মোস্তফা কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নসংক্রান্ত একটি প্রকল্প আমাদের কাছে এসেছে। আমরা সেটা পর্যালোচনা করে দেখেছি।’ তিনি জানান, সরকারের একটি নিয়ম আছে, ২৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে কোনো প্রকল্প হাতে নিলে সে প্রকল্পের ওপর একটি বিস্তারিত সমীক্ষা করতে হয়। পরিবেশগত একটি প্রভাব মূল্যায়ন করতে হয়। কিন্তু এই প্রকল্পে করা হয়নি।

মোস্তফা কামাল বলেন, ১০ তলা ভবন হলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হতে পারে। ক্যাম্পাসে পাখি, প্রজাপতি, গুইসাপ, বেজি, কাঠবিড়ালিসহ বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। বহুতল ভবন হলে সেখানে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে কি না, তার জন্য একটি বিস্তারিত সমীক্ষা করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। ১০ তলার পরিবর্তে পাঁচতলা অথবা ছয়তলার ভবন নির্মাণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।

গত বছর ভূমিকম্পের সময় হুড়াহুড়ি করে নামতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারতলা একটি হলেই কয়েকজন আহত হয়েছিল। সেখানে আরো বহুতল হলে হতাহতের আশঙ্কা আরো ভয়াবহ হবে। তা ছাড়া ক্যাম্পাসে অতিথি পাখি আসা যখন কমতে শুরু করেছে, সেই পরিস্থিতিতে বহুতল ভবন করার উদ্যোগে ক্ষুব্ধ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সত্তরের দশকে তৈরি করা মাস্টারপ্ল্যানে ক্যাম্পাসে বহুতল ভবন নির্মাণে নিষেধ আছে। সেটি না মেনেই বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, তাঁরাও ক্যাম্পাসের উন্নয়ন চান। আবাসনব্যবস্থার পুরোপুরি নিশ্চয়তা চান। তবে সেটা অবশ্যই প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে অক্ষুণ্ন রেখে করতে হবে। যে ক্যাম্পাসকে দেশের মানুষ নয়নাভিরাম ক্যাম্পাস হিসেবে চেনে, জানে, সেখানে জীববৈচিত্র্যই যদি না থাকে, তাহলে এত অবকাঠামো দিয়ে কি হবে—এমন প্রশ্নও রাখেন তাঁরা।

এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন অধ্যাপক—আমির হোসেন ভুঁইয়া, আকতার মাহমুদ ও মনিরুল এইচ খানের সঙ্গেও কথা হয়। তাঁরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসনব্যবস্থার দরকার আছে। তবে তা যেন কিছুতেই পাখি, জীববৈচিত্র্য, শিক্ষা ও গবেষণা এলাকায় নির্মাণ করা না হয়—সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

অবশ্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, সত্তরের দশকের সঙ্গে এখনকার সময়ের তুলনা করা ঠিক হবে না। গত চার দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। সঙ্গে শিক্ষকের। এর সঙ্গে কর্মচারীর সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু সে সঙ্গে বাড়েনি আবাসনব্যবস্থা। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মচারীদের আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববৈচিত্র্যের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলেও মনে করে প্রশাসন।