
রাজধানীর পুরান ঢাকা, রমনা ও ফার্মগেট এলাকায় অনেক ঐতিহাসিক ভবন ও স্থাপনা ভেঙে ফেলার হিড়িক পড়েছে। পরিবর্তন করা হচ্ছে পুরাকীর্তির দাবিদার অনেক ভবনের কাঠামো। সম্প্রতি ফার্মগেটের খামারবাড়ির শতবর্ষী ল্যাবরেটরি ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে। এর প্রতিবাদে নগরীর মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে। মানববন্ধন, সভা-সেমিনার, উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করা হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু রক্ষা করা যায়নি।
এদিকে পুরান ঢাকার বি কে দাস রোডে উমাচরণ সাহার ঐতিহাসিক বাড়িটি নতুন করে ভাঙা শুরু হয়েছে। ওই বাড়িটি ব্রিটিশ আমলে লাল ইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। কয়েক বছর আগে নগরবিদ ও এলাকার মানুষের বাধার মুখে প্রশাসন ওই বাড়িটি ভাঙা বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু গত ১১ জানুয়ারি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ভবনটি নতুন করে ভাঙা হচ্ছে। একই সঙ্গে ৬৫ নম্বর শাঁখারীবাজারের আরেকটি ঐতিহাসিক ভবন গোপনে ভাঙার কাজ চলছে। ৪১, ৪২, ৪৩ নম্বর হৃষিকেশ দাস রোডের আরেকটি ঐতিহাসিক বাড়ি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত হলেও পরে হাইকোর্টের আদেশে তা স্থগিত রাখা হয়।
পুরাতত্ত্ববিদদের অভিযোগ, কিছু মানুষ আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার জোরে খামারবাড়ির ঐতিহাসিক ল্যাবরেটরি ভবনটি ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাঁরা ঐতিহাসিক স্থাপনাকে পুরনো ও বিপজ্জনক স্থাপনা আখ্যা দিয়ে এ কাজটি করেছেন। এ ধরনের সিদ্ধান্ত শুধু অন্যায়ই নয়, ফৌজদারি অপরাধের সমান। তবে আশ্চর্যের বিষয়, এসব অন্যায় দেখার জন্য ঢাকায় কোনো কর্তৃপক্ষ নেই।
ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন স্থপতি এবং আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলাম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘লাল ইটের এই ভবনগুলো বহন করছে আমাদের হারানো ঐতিহ্য। এর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অতীত ইতিহাসের উপাদান। লাল ইটের ভবন ছাড়াও ব্রিটিশ আমলে নির্মাণ করা সাদা ও হলুদ রঙের সরকারি-বেসরকারি অনেক স্থাপনা রয়েছে ঢাকায়। ব্রিটিশ আমলে নির্মাণ করা এসব স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে ঢাকা নগরীর ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত জড়িয়ে আছে। এসব না ভেবেই নির্বিচারে ভাঙা হচ্ছে লাল ইটের ঐতিহাসিক ভবন।’
তাইমুর ইসলাম জানান, গত তিন-চার মাসে ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষায় ছয়টি রিট করা হয়েছে। প্রতিটি রিটেই পুরনো এই স্থাপনাগুলো রক্ষার পক্ষে রায় এসেছে। তার পরও আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কেউ কেউ এসব স্থাপনা ভাঙছে। ৬৫ নম্বর শাঁখারীবাজারের ভবনটি না ভাঙতে উচ্চ আদালত নির্দেশ দিলেও সম্প্রতি রাতের অন্ধকারে ভবনটির কিছু অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। রাজধানীতে এ ধরনের প্রায় দুই হাজার ৫০০টি স্থাপনা রক্ষায় তাঁরা কাজ করছেন।
ফার্মগেটের খামারবাড়ি একসময় মনিপুরী খামার হিসেবে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশ আমলে দেশের কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে খামারটি গড়ে তোলা হয়। ১৯০৬ সালে প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর খামারবাড়ি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে সময় খামারবাড়ি এলাকাটি ‘মুনিপুর ফার্মস’ হিসেবে পরিচিত ছিল। পরে মুনিপুর ফার্মসটি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে (ইঅজও) রূপান্তরিত হয়।
১৯২২ সালের মানচিত্রে খামারবাড়ি সড়ক ধরে সারিবদ্ধ বাংলো প্যাটানের দোতলা ভবনের উল্লেখ রয়েছে। লাল ইটের এসব ভবনের কোনোটায় গবেষণাগার, কোনোটায় পরীক্ষাগার, কোনোটায় প্রশাসনিক অফিস আবার কোনোটায় বাসভবন ছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এর অধিকাংশই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
ইতিহাসবিদ ড. শরীফ উদ্দিন আহমেদের বিবরণী থেকে জানা যায়, বঙ্গভঙ্গের পর ১৯০৬ সাল থেকে ঢাকায় নতুন শহরের পত্তন ঘটে। রমনার বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রশাসনিক এলাকা গড়ে তোলা হয়, যা সিভিল স্টেশন নামে পরিচিতি অর্জন করে। তখন সেখানে লাল ইটের বাংলো টাইপের বেশ কিছু ভবন নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে পুরনো হাইকোর্ট ভবন, বড় লাটের বাসভবন, রমনা হাউস, চামেলী হাউস, বর্ধমান হাউস অন্যতম। মিন্টো রোডের আবাসিক এলাকার ভবনগুলো ছিল লাল ইটের। এগুলো ছাড়া আরো অনেক লাল ইটের ভবন ছিল রমনা প্রশাসনিক এলাকায়। এর মধ্যে বেশ কিছু ভবন ভেঙে সেখানে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। যেগুলো অবশিষ্ট আছে সেগুলোর রং পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে জানা যায়, পুরনো ঢাকার ওয়ারী আবাসিক এলাকার সিংহভাগ লাল ইটের বাংলো টাইপের আবাসিক ভবনগুলো প্রকাশ্যে ধ্বংস করা হয়েছে। একতলা কিংবা দোতলা ব্রিটিশ স্থাপত্যের নিদর্শনগুলো ভেঙে সেখানে ১০-১৫ তলা এমনকি ২০ তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত এলাকাটি এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
ব্রিটিশ আমলের স্থাপনাগুলোয় অর্ধবৃত্তাকার খিলান, অলংকৃত ডেন্টিলসহ কার্নিশ ও অলংকরণ করা ছাদে রেলিং নির্মিত। ওই সময় নির্মিত অসংখ্য ভবনের মধ্যে ইউরোপীয় ধ্রুপদী স্টাইলে আয়নিক বা কোরিন্থিয়ান অর্ডারসমৃদ্ধ অলংকরণ দেখা যায়। বাড়তি অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে নানা ধাঁচের ব্যালকনি। কোথাও কোথাও মোগল স্থাপনাগুলোর আংশিক পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে এর স্থাপত্যরীতির ওপর ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর ছাপ দেখা যায়। যে কারণে ঢাকায় লাল ইটের ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতির নিদর্শনগুলোর গুরুত্ব অনেক বেশি।
ওয়ারী ছাড়াও বনগ্রাম, লালমোহন সাহা স্ট্রিট, পাটুয়াটুলী, ফরাশগঞ্জ, সদরঘাট, ইসলামপুর, বাংলাবাজার, সূত্রাপুর ও লক্ষ্মীবাজার এলাকায় একসময় লাল ইটের অসংখ্য ভবন ছিল। এখন আর এসব ভবনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। লক্ষ্মীবাজারে লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দিরের বিশাল ভবন, ফরাশগঞ্জে ঢাকার সর্ববৃহৎ রূপলাল হাউস, কুমারটুলীর আহসান মঞ্জিল টিকে থাকলেও এ ভবনগুলোর আদি রূপ হারিয়ে গেছে।
পূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, বিভিন্ন দপ্তর থেকে প্রতিনিয়ত পুরনো ভবনগুলো ভেঙে সেখানে নতুন ভবন নির্মাণের তাগিদ আসছে। সে তাগিদ থেকেই খামারবাড়ির ল্যাবরেটরি ভবনটি ভাঙা হয়। উচ্চ আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা জারির পর পূর্ত মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ভবন ভেঙে সেখানে নতুন ভবন নির্মাণের ব্যাপারে এই মন্ত্রণালয়ের আরো জোরালো ভূমিকা থাকা উচিত। কিন্তু এরই মধ্যে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন রাজউক থেকে পুরাকীর্তির তালিকা ছেঁটে ফেলা হয়েছে।
একাধিক নগরবিদ জানান, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে পুরান ঢাকার সংরক্ষিত ১৩টি এলাকা তুলে দিয়ে নতুন করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। এর ফলে ফরাশগঞ্জ, বাংলাবাজার, প্যারীদাস রোড, সূত্রাপুর, বি কে দাস রোড এলাকার যেকোনো ঐতিহাসিক ভবন ভাঙা যাবে। ২০১২ সালে একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ঢাকার পুরনো ভবন এবং পুরাকীর্তি রক্ষার জন্য একটি যোগ্য কমিটির মাধ্যমে নতুন করে তালিকা প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়ন না করেই রাজউক নতুন একটি তালিকা করে গেজেট প্রকাশ করে। সেখানে ৯৮টি স্থাপনার উল্লেখ থাকেলও রহস্যজনকভাবে সংরক্ষিত ১৩টি এলাকা নেই।
পুরান ঢাকার সংরক্ষিত এলাকার তালিকার নতুন গেজেটের কথা রাজউক থেকে স্বীকার করে বলা হয়, একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশেই তা করা হয়েছে। মূলত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো সংস্কার কিংবা নতুন ভবন নির্মাণের সুবিধার্থে এটা করা হয়েছে। এতে ঐতিহাসিক পুরাকীর্তির কোনো ক্ষতি হবে না।
রাজউকের নগরবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, পুরনো তালিকাটি হালনাগাদ করা হয়েছে। যেমন আগে পুরো শাঁখারীবাজার ছিল সংক্ষিত এলাকা। এখন নির্দিষ্ট কিছু ভবন রেখে বাকি ভবনগুলো অবমুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। পুরান ঢাকার অন্যান্য এলাকায়ও একই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
সরেজমিনে এসব এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে শত শত ঐতিহাসিক ভবন রয়েছে। মোগল-ব্রিটিশ শিল্পশৈলীর আদলে স্থাপনাগুলো নির্মিত। চার শ বছরের পুরনো একটি নগরীর বৈশিষ্ট্য হলো এসব ভবন। রাস্তার দুই পাশের এসব ভবনের দিকে তাকালে ঢাকার ঐতিহাসিকতা ফুটে ওঠে। কিন্তু ১৩টি এলাকা পুরাকীর্তির তালিকা থেকে তুলে ফেলায় সেসব এলাকার এসব স্থাপনা নির্বিচারে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
এ নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সরকার আইন তুলে দিলে পুরান ঢাকায় কোনো ঐতিহাসিক ভবন অবশিষ্ট থাকবে না। প্যারীদাস, রেবতী মোহন দাস, রূপলাল দাস রোড, ফরাশগঞ্জ, বাংলাবাজার, সূত্রাপুর এলাকায় অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির বাড়ি এবং স্থাপনা রয়েছে। কেউ যদি এসব এলাকার পুরনো বাড়িঘর নির্বিচারে ভেঙে ফেলে তাহলে আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যাবে না।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে পড়াশোনা করছেন ইন্দ্রনাথ সেন। তিনি কলকাতা-ঢাকা নগরীর ব্রিটিশ স্থাপত্য নিয়ে একটি গবেষণাপত্র তৈরি করছেন। পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জ সড়কে তাঁর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি জানান, ঢাকা মোগল নগরী হলেও এখানে মোগল নিদর্শন নেই বললেই চলে, যা কিছু টিকে আছে এর অধিকাংশ ব্রিটিশ আমলে লাল ইটের তৈরি। সেগুলোও নির্বিচারে ভেঙে ফেলা হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় থাকা ঐতিহাসিক ভবনগুলো ধ্বংস করা হলেও পুরাতত্ত্ব বিভাগ নীরব ভূমিকা পালন করছে।
সমপ্রতি সরকার পুরান ঢাকার বিভিন্ন সড়ক ও সংরক্ষিত এলাকার ওপর থেকে সংরক্ষণের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় একটার পর একটা ঐতিহাসিক স্থাপনা ভেঙে ফেলা হচ্ছে। আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের পথটিও রুদ্ধ। গতকাল শুক্রবার আরবান স্টাডি গ্রুপের পক্ষ থেকে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় মানববন্ধন করা হয়েছে। এতে অংশগ্রহণ করেছে এলাকার সাধারণ মানুষ।