আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
আবাসিকের চরিত্র হারিয়েছে নগরীর অভিজাত এলাকা

নীতিমালা না মানার কারণে রাজধানীর ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী থেকে উত্তরা মডেল টাউন পর্যন্ত এলাকার আবাসিক চেহারা হারিয়ে যাচ্ছে। সেখানে কোনটা আবাসিক আর কোনটা বাণিজ্যিক বা শিল্প এলাকা তা বুঝে ওঠা কঠিন হয়ে পড়েছে। আবাসিক ভবনেরই নিচতলায় কারখানা কিংবা ওয়ার্কশপ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দোতলা, তিনতলা ও চারতলাকে বানানো হয়েছে মার্কেট। এরও উপরের তলাসমূহ ব্যবহৃত হচ্ছে আবাসিক ফ্ল্যাট হিসেবে। একই স্থানে শিল্প-বাণিজ্য-আবাসিকের সহাবস্থান চলছে। সব মিলিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অস্বস্তিকর পরিবেশ।

জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে রাজউক থেকে আবাসিক ভবন নির্মাণের নামে প্লট বরাদ্দ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা অনাবাসিক ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করে আসছেন। বরাদ্দের চুক্তিপত্র লঙ্ঘন করে আবাসিক প্লটে কেউ কেউ শিল্প-কারখানা গড়ে তোলেন। চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে রাজউক দফায় দফায় প্লট মালিকদের নোটিস দিয়েছে। বাণিজ্যিক স্থাপনাসমূহ ভেঙে ফেলার জন্যও চরমপত্রও পাঠানো হয়েছে। গুলশান-বনানীতে আবাসিক প্লটসমূহে অবৈধভাবে বাণিজ্যিক ভবনসহ শিল্প-কারখানা স্থাপন করেও প্রভাবশালী মহল পার পেয়ে যাচ্ছে।

এরই মধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) অভিনব প্রস্তাবও দেয় তাদের। কাঠাপ্রতি স্থানভেদে চার থেকে আট লাখ টাকা রূপান্তর ফি জমা দিয়ে বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে বৈধ করিয়ে নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। এ জন্য ৬০ দিনের সময়সীমাও বেঁধে দেয়।

রাজউকের এস্টেট বিভাগের কর্মকর্তারা তদন্ত শেষে চুক্তিপত্রের চরম লঙ্ঘনকারী হিসেবে ১৩৯টি প্লট চিহ্নিত করেন। এ ছাড়াও অনুমোদিত নকশা-ডিজাইন পরিবর্তন-পরিবর্ধনের মাধ্যমে নির্মিত আরও প্রায় আড়াইশ ভবনের তালিকাও তৈরি করেন। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় এ ধরনের অবৈধ বাণিজ্যিক ভবনে রূপান্তরিত ভবনের সংখ্যা সহস্রাধিক বলে জানা গেছে। চূড়ান্ত নোটিসে দুই মাস সময়সীমার মধ্যে অননুমোদিত ভবনসমূহ ভেঙে ফেলা ও বাণিজ্যিক ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। অন্যথায় অবৈধভাবে নির্মিত ভবনসমূহ ভেঙে প্লট বরাদ্দ বাতিল করারও ঘোষণা দেয়।

কিন্তু রাজউকের এসব হুমকি, নোটিস, ঘোষণাকে মোটেও পাত্তা দেননি প্লট মালিকরা। বরং বনানী থেকে উত্তরা পর্যন্ত আবাসিক ভবনসমূহের অবৈধ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার কার্যক্রমের বিস্তৃতি ঘটেছে। এক্ষেত্রে রাজউকের নোটিস-নির্দেশের বিরুদ্ধে একাধিক প্লট মালিক মামলার আশ্রয় নেন এবং কেউ কেউ আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে সময়ক্ষেপণ করছেন। এ সুযোগে অননুমোদিত ভবন নির্মাণকারী প্লট মালিকদের সঙ্গে এস্টেট বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তার গোপন যোগসাজশ গড়ে ওঠায় দুই বছরেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ধানমণ্ডি ও গুলশান আবাসিক এলাকার প্রায় সবগুলো সেক্টর, অলিগলির শত শত বাসাবাড়িতে গড়ে উঠেছে অবৈধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কয়েকটি ব্র্যান্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর পিকিউএসর বিলাসবহুল দোকান। এ ছাড়া রয়েছে ওয়েস্টটেক্স, রেক্স, প্রিটেক্স নামে আরও কয়েকটি সুপরিচিত দোকান। ব্যাংকের শাখা আছে বাড়ি বাড়ি। অনেক বাড়ির গ্যারেজও পরিণত হয়েছে কনফেকশনারিতে। এই এলাকার বাসাবাড়ি ভাড়া করে তৈরি হচ্ছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, কমিউনিটি সেন্টার, রেডিমেড গার্মেন্ট দোকান। এমনকি কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসও রয়েছে বেশ কয়েকটি। এ ছাড়া বই-পুস্তকের লাইব্রেরি বসানো হয়েছে অর্ধ শতাধিক। মডেল টাউন ছাড়াও মহাখালী, আরজতপাড়া ও নাখালপাড়ার অলিগলির বাড়িগুলো পর্যন্ত বাণিজ্যিক ভবনে পরিণত হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মালিক বলেন, বাসাবাড়ি ভাড়া করে দোকান দিলে ভাড়া তুলনামূলকভাবে কম পড়ে।

আরেক বাড়িওয়ালা রবিউল ইসলাম বলেন, বাসাবাড়ি বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দিলে বেশি ভাড়া পাওয়া যায়। উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের প্রায় পুরোটাই এখন মার্কেটে পরিণত হয়েছে। ৩ নম্বর সেক্টরের রবীন্দ্র সরণিতে রয়েছে ইষ্টিকুটুম নামে কমিউনিটি সেন্টার যা ভাড়া বাড়িতে চলছে। ৩, ৬, ৭ ও ৫ নম্বর সেক্টরের প্রায় প্রতিটি সড়কের বাসাবাড়িতে দোকানপাট গড়ে উঠেছে।

সূত্র মতে, অভিজাত গুলশান-বনানীর ক্যান্সার হিসেবে পরিণত হয়ে আছে মহাখালীর হাজারীবাড়ি ও আরজতপাড়া এলাকা। পরিকল্পিত নগরায়নে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই দুটি এলাকায় যার যেমন খুশি বাড়িঘর গড়ে তুলছেন। রাস্তাঘাট, গলিপথ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ, কবরস্থানের জন্য এক চিলতে জায়গা ফাঁকা রাখছেন না। দেয়াল ঘেঁষে ৫-৬ তলা বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। মহাখালীর রাজউকের জোনাল কার্যালয় ঘেঁষা পশ্চিম পাশে অবৈধ বিল্ডিং নির্মাণের পাল্লা চলছে। রাজউক দফতরে অভিযোগ করেও ফল মেলে না। যারাই অভিযোগ করেন তাদের নানাভাবে হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট অথরাইজড অফিসার সুকুমার বড়ুয়ার বিরুদ্ধে প্রতিটি নির্মাণাধীন ভবন থেকে বখড়া আদায়ের অভিযোগকারীদের নানাভাবে হয়রানি করার অনেক অভিযোগ রয়েছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে সুকুমার বড়ুয়া জানান, রাজউকের নোটিসকে কোনো পাত্তা দেন না বাসিন্দারা।

রাজউক চেয়ারম্যান জানান, ভবন মালিকদের চাপ-তদবির তো আছে, থাকবেই। তাদের অন্যায় অনুরোধ রক্ষা করতে গেলে ঢাকা নগর রক্ষা করা যাবে না। এ কারণে অবৈধ স্থাপনা ভাঙার ক্ষেত্রে এবার কোনো তদবির-চাপ বাধা হতে পারবে না। অন্যদিকে আবাসিক প্লটে অবৈধ বাণিজ্যিক কাঠামো নির্মাণের দায়ে অভিযুক্ত মালিকরা বলেছেন, রাজউক দুই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিপাকে ফেলেছে। কাউকে বাণিজ্যিক ভবনে রূপান্তরের সুযোগ দিচ্ছে, কারও ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে ভবন ভেঙে ফেলার নির্দেশ।