
রামপালে হতদরিদ্র ছিন্নমূল ভূমিহীন পরিবারের বসবাসের জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকারিভাবে নির্মিত অধিকাংশ আবাসন প্রকল্প এখন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অগ্রাধিকার ভিত্তিক পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন সরকারের আমলে রামপাল উপজেলায় ১১টি আবাসন প্রকল্প নির্মিত হয়েছে। এ প্রকল্পভুক্ত ঘরগুলোর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থা ধারণ করেছে। এসব আশ্রায়ন প্রকল্পে বসবাসকারী পরিবারের প্রায় জন মানুষ বর্তমানে পানীয় জলের চরম কষ্টে ভুগছে। সেই সাথে ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা। চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এসব জনবসতির পাশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় জীবন জীবিকার চরম সংকট দিনাতিপাত করছে এসব ছিন্নমূল পরিবারের সদস্যরা।
বাঁশতলী, শ্রীফলতলা, সিকিরডাঙ্গা-১, ২ ও পারগোবিন্দপুরসহ বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প এলাকা সরেজমিন ঘুরে ও বসবাসকারী পরিবার সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে তারা খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। বাঁশতলী গিয়ে দেখা গেছে, এখানে ৮টি শেডে ১০টি করে কক্ষ আছে। এখানে বাথরুমের অবস্থা খুব খারাপ, ট্যাঙ্কির ঢাকনা নেই, ময়লা বের হয়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়। ঘরের চালের টিন সব মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টির পানি পড়ে, ঘুণে ধরে ও উইপোকায় খেয়ে পেলায় ঘরের কাঠামো খসে খসে পড়ছে। ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘরে থাকতে ভয় লাগে। চলাচলের জন্য রাস্তা না থাকায় বর্ষার সময়ে যাতায়ায়াতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। মাত্র ৫০০ গজ দূরে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা থাকলেও আজও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি এ আবাসন প্রকল্পে। প্রায় ১৫ বছর আগে সরকারিভাবে নির্মিত এ ঘরগুলো সংস্কার না করায় খুব নাজুক হয়ে পড়েছে। একই ধরনের সমস্যার কথা উঠে আসে ঐ প্রকল্পের বাসিন্দা তানজিলা বেগম, ফরিদা বেগম, আ. রাজ্জাক, নূরজাহান বেগমের বক্তব্যে।
সিকিরডাঙ্গা আবাসন প্রকল্প-২ এ গিয়ে দেখা যায়, এখানে ৬টি টিনশেড ব্রাকে ৬০টি পরিবার বসবাস করেন। এখানের ল্যাট্রিনগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। কয়েকটি ল্যাট্রিন সরাসরি পার্শ্ববর্তী লেকের সাথে সংযুক্ত হয়ে পড়ায় পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। সিকিরডাঙ্গা আবাসন প্রকল্প-১ এ ২টি ফেজে ১২০টি পরিবার বসবাস করেন। এর মধ্যে ১ বছর পূর্বে বিদ্যুতের সর্টসার্কিট দুর্ঘটনায় একটি ব্র্যাক পুড়ে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়। এতে ১০টি পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করে আসছেন। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু ত্রাণ সহায়তা পেলেও শেডটি এখনও পুনঃনির্মাণ করা হয়নি।
শ্রীফলতলা আবাসন প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায় প্রায় একই চিত্র। ঐ প্রকল্পে ২টি পেজের ১৫টি শেডে ১৫০টি পরিবার বসবাস করেন। এর মধ্যে প্রায় ৮ বছর পূর্বে অগি্নকা-ের ঘটনায় একটি শেড সম্পূর্ণরূপে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়। নামমাত্র যৎসামন্য ত্রাণ সহায়তা ছাড়া আর কিছুই জোটেনি ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি পরিবারের সদস্যদের ভাগ্যে। এখানেও বাঁশতলী আবাসন প্রকল্পের অনুরূপ সমস্যা বিরাজমান। এ প্রকল্পের বাসিন্দা নাহার বেগম জানান, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জে. মঈনের আশার আলো প্রকল্পের মাধ্যমে গাভী পালন ও বায়োগ্যাস প্লান্ট নির্মাণ করা হয়। প্রকল্পটি ২ বছরের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে। এখানে ল্যাট্রিনগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঘরগুলোও নাজুক হয়ে পড়েছে।
পারগোন্দিপুর আবাসন প্রকল্প কয়েকটি ফেজে বেশকিছু ভবন ও শেড নির্মাণ করা হয়েছে। এরমধ্যে ৭৫টি পরিবারের জন্য ১৫টি ভবন নির্মাণ করা হয়। ভবনের বাসিন্দা ফাতেমা বেগম ও মিরাজ শেখ জানান, জলছাদ না থাকায় ভবনের ছাদ দিয়ে বর্ষার সময় পানি পড়ে। ল্যাট্রিনগুলোর অবস্থাও বেশ খারাপ। পুুকুরে ঘাট নাই, টিউবওয়েল নষ্ট। ২নং ফেজে গিয়ে দেখা যায়, ২০১১ সালে ১৯টি টিনশেড ব্র্যাক নির্মাণ করা হয়। এতে প্রায় ৯৫টি পরিবার বসবাস করেন। এ ব্র্যাকের আঞ্জু শেখ জানান, এখানে ৭ বছরেও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়নি। কোনো রাস্তাঘাটও নেই। বৃষ্টির সময় ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে খুব কষ্ট হয়। কথা হয়, ৩য় ফেজের বাসিন্দা মোমেনা বেগমের সাথে তিনি বলেন, এখানে ৪০টি শেডের ৮০টি পরিবার বসবাস করে। ঘরের দরজা জানালা নষ্ট হয়ে গেছে। ২টি মাত্র টিউবওয়েল থাকায় পানির খুব সমস্যা।
গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প-২ এর বাসিন্দা ছায়রা বেগম জানান, এখানে বিদ্যুৎ আছে কিন্তু ল্যাট্রিনগুলো নষ্ট। ৫/৬টি পরিবার ঘর নিলেও এখানে থাকেন না। আশ্রায়ন প্রকল্প ফেজ-২ এর সভাপতি আনছার আলী জানান, এখানে ২০টি শেডে ১শটি পরিবার বসবাস করেন। এখানে বিদ্যুৎ সংযোগ নাই। বাথরুমগুলো নষ্ট, বর্ষার সময় ময়লা উপচে পড়ে। রাস্তাঘাট নাই। খুব কষ্ট করে এখানে থাকতে হয়। তিনি আরও জানান, মাদক ব্যবসা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ৮/১০ সন্ত্রাসী এখানে আনাগোনা করে। তিনি আবাসনের বাসিন্দাদের সকল সমস্যা সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
আবাসন প্রকল্পগুলোর সমস্যার বিষয় নিয়ে কথা হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তুষার কুমার পালের সাথে। তিনি জানান, আমি পর্যায়ক্রমে আবাসন প্রকল্পগুলোতে গিয়ে বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে কিছু সমস্যার কথা জেনেছি। সরকারিভাবে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণের সাথে কথা বলে সমস্যার সমাধান করা হবে। উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ মো. আবু সাইদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, আবাসনগুলোর সমস্যার সমাধানের জন্য একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখলেও এখনও কোনো প্রকার সহায়তা পাওয়া যায়নি তবে তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন বরাদ্দ সহায়তা দিয়ে বাসিন্দাদের সমস্যার সমাধান করা হবে।