
পুরো রাজধানী ঢাকাই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে। বিশেষ করে কোথাও না কোথাও প্রতিদিনি অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে উঁচু-নিচু অট্টালিকা। আর কোথাও কোন ভবন নির্মাণ হচ্ছে তার দেখবাল করার দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউকের। কিন্তু রাজউক এ বিষয়ে তেমন কোন নজর রাখছে না। এমনকি রাজধানীতে কতটি ভবন রয়েছে তার সঠিক কোন হিসেবও নেই রাজউকের কাছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিকল্পিত নগরায়নের পরিবর্তে অপরিকল্পিত নগরায়নের দিকে ঝুঁকছে রাজধানীর জমির মালিকরা। তারা তাদের জমিনে ভবন নির্মাণের ক্ষেতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়ম কানুন মানছে না। এতে অবৈধ ভবনের পাশাপাশি বাড়ছে ভূমিকম্পে ব্যাপক প্রাণহানির ঝুঁকি। এভাবে চলতে থাকলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নগরী বসবাসের অযোগ্য হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে ভবনের সঠিক পরিসংখ্যান রাজউকের কাছে থাকা প্রয়োজন। কেননা, নগরীর উন্নয়ন করতে হলে পরিসংখ্যান অনুযায়ী পরিকল্পনা নিতে হবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছে তা নেই। ফলে অপরিকল্পিতভাবে যে নগরায়ণ হচ্ছে তাতে ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ঢাকা। তাদের মতে, রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকার ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে হলেই নগরীর ৩৫ শতাংশ ভবন ধসে পড়বে।
বিপুল জনগোষ্ঠীকে ধারণ করতে গিয়ে ঢাকায় প্রতিনিয়ত অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে নতুন নতুন ভবন। মূল ঢাকায় জায়গা না থাকায় এখন শহরের আশপাশের ডোবা কিংবা নালা ভরাট করেও ইচ্ছেমতো আবাসনের ব্যবস্থা করছে নগরবাসী। সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় আবাসনের পাশাপাশি মৌলিক নাগরিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত থাকছেন তারা। মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উঁচু-নিচু অট্টালিকা। যার বেশিরভাগই নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নির্মিত হচ্ছে। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও অপরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থার জন্য নগর পরিকল্পনাবিদরা দায়ী করছেন রাজউককে। পাশাপাশি এলোমেলোভাবে বেড়ে ওঠা এই নগরীর লাগাম এখনই না টানতে পারলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে বলেও আশঙ্কা তাদের।
রাজউক সূূত্রে জানা যায়, মুল নগরী ছাড়াও ডিটেইল এরিয়া প্লানের (ড্যাপ) অধীনে রাজধানীর আশপাশের এলাকায় প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক ভবন রয়েছে। তবে কোন ভবনের তালিকা রাজউকের কাছে নেই। এ ছাড়া ২০১০ সালে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া কেরানীগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকার অংশবিশেষ ড্যাপের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এসব এলাকা রাজউকের আওতায় এলেও এখন পর্যন্ত সেখানে কোনো কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি সংস্থাটি। এসব এলাকার বাসিন্দাদের রাজউকের অনুমোদন নিয়ে ভবন নির্মাণের কথা থাকলেও তারা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে ভবন নির্মাণসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করছেন। আবার অনেকে অনুমোদন ছাড়াই ভবন নির্মাণ করছেন। ফলে এসব এলাকা রাজউকের আওতায় এলেও কী পরিমাণ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে তার কোনো তালিকা রাজউকের কাছে নেই। তবে স্থানীয় নথিপত্র অনুযায়ী ড্যাপের আওতাধীন এলাকার মধ্যে নারায়ণগঞ্জের ডিএনডি এলাকায় প্রায় দেড় লাখ ভবনসহ নারায়ণগঞ্জ জেলায় দুই থেকে আড়াই লাখ, গাজীপুর জেলায় প্রায় দুই লাখ, সাভার-আশুলিয়া ও কেরানীগঞ্জে প্রায় এক থেকে দেড় লাখ ভবন রয়েছে। এসব ভবন নির্মাণে নকশার অনুমোদন রয়েছে কি না, মানসম্মত কি না তা রাজউকের জানা নেই। ফলে তিন বছর আগে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন এবং অনুমোদন ছাড়াই নির্মিত এসব এলাকার ভবনগুলো ব্যবহার উপযোগী কি না তার মান পরীক্ষার উদ্যোগ নেয় রাজউক। কিন্তু এ উদ্যোগে সফল হতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এদিকে নিয়ম অনুযায়ী নকশার অনুমোদন দেওয়া সংস্থাটি ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার ভবনের অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও গড়ে উঠছে অবৈধ ভবন। ফলে পরিকল্পনা ছাড়াই যততত্র ভবন নির্মাণ হচ্ছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী ইনামুল হক বলেন, রাজউক তাদের নীতিমালা বাস্তবায়নের পরিবর্তে নতুন নতুন প্রকল্প বানাচ্ছে। কিন্তু এটি বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোও করতে পারত। ঢাকার মাটির গঠন অনুযায়ী কোথায় উঁচু ভবন হবে, কোথায় নিচু ভবন হবে, সেটি নির্ধারণ করা জরুরি। সঙ্গে সঙ্গে জরুরি বাড়ি ও স্থাপনার ঘনত্ব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
রাজউকের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, শহরের মধ্যে শিল্প স্থাপনা থাকার কথা নয়। বেশ কিছু প্রকল্প ছাড়াও পরিকল্পিত নগরীর জন্য নতুন করে স্যাটেলাইট সিটির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এই কর্মকর্তা আরো বলেন, রাজউকের কাছে নকশার অনুমোদন দেওয়ার কিছু তালিকা আছে। কিন্তু ভবনের সংখ্যা কত সেটা শুমারি করেনি। তবে ২০ লাখের মতো হতে পারে। শুমারির বিষয়ে তিনি বলেন, আটটি অঞ্চলে মাত্র ৫৭ জন ইন্সপেক্টর আছেন। তাদের দিয়ে নির্ধারিত কাজের বাইরে নতুন করে আরো কিছু করা সম্ভব নয়। তবে নতুন করে ১২০ জন ইন্সপেক্টর নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। নিয়োগ কার্যক্রম শেষ হলে এ সমস্যাগুলো সমাধান হবে।