আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
আটকে আছে রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণ

তিন সেবা সংস্থার ঠেলাঠেলিতে আটকে আছে রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণ। বছরের পর বছর চলা ঠেলাঠেলির এখনও সমাধান করতে পারেনি সরকার। এতে ভূমিকম্পসহ বড় দুর্যোগে ভয়াবহ ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই শহরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো। গণমাধ্যম, নগর বিশ্লেষক ও গবেষকরা এসব নিয়ে বারবার সতর্ক করেলেও এর সুরাহা হচ্ছে না।

ঢাকা শহরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণের দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি)। আইনে এ তিন সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়ায় এক সংস্থা অন্য সংস্থার ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করছে। ফলে ছয় বছর আগের মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ তালিকার ৩২১ ভবনের একটিও অপসারণ হয়নি। এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৭২ হাজার বলে দাবি করেছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কোনো হিসাব নেই রাজউক, ডিএনসিসি, ডিএসসিসির কাছে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির এক কার্যপত্রে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকারি এক প্রজ্ঞাপনে শাঁখারিবাজার, ফরাশগঞ্জ, সূত্রাপুর ও মিন্টো রোড এলাকাকে সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করে। প্রজ্ঞাপনে ওইসব এলাকার পুরনো ভবনগুলো সংরক্ষণের পাশাপাশি প্রয়োজনে অপসারণ এবং সংস্কারের কথা বলা হয়। ওই সময়েই ঝুঁকিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ ভবন দ্রুততার সঙ্গে অপসারণের উদ্যোগ নিতে সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি। তাদের সুপারিশের আলোকে ঝুঁকিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ ভবন চিহ্নিত করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে রাজউক। ওই কমিটি পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ার পর ৩২১টি ভবনকে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। এছাড়াও ৩৩৭টিকে ঝুঁকিপূর্ণ, ৮০টি মাঝারি এবং ১৬৮টিকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বেশিরভাগই পুরান ঢাকায় অবস্থিত।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঝারি বা বড় মাত্রার ভূকম্পন হলে এসব ভবন ধসে বড় ধরনের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। বড় বিপর্যয় ঘটার আগে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে সতর্ক হতে হবে।

সিটি কর্পোরেশন আইন-২০০৯-এ শহরের মহাপরিকল্পনা অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সিটি কর্পোরেশন শহরের পরিকল্পনা, ভূমি উন্নয়ন, ভূমি উন্নয়ন প্রকল্প কার্যকর, ইমারত নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে। অন্যদিকে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮-এ রাজধানী এবং আশপাশের এলাকার ভবন নির্মাণ, বসবাস সনদপত্র প্রদান এবং নবায়ন, অনুমোদিত নকশার ভিত্তিতে ভবন নির্মাণ নিশ্চিতকরণ, ইমারত নির্মাণের সময়কাল, নকশা সংশোধনসহ প্রভৃতি কার্যক্রমের দায়িত্ব রাজউককে দেয়া হয়েছে।

রাজউক রাজধানীসহ কেরানীগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এলাকার নগরপরিকল্পনা প্রণয়ন, ভূমির উন্নয়ন, ভবন নির্মাণের অনুমোদন, ভূমি উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন প্রভৃতি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আর ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি নিজস্ব জায়গায় মার্কেট, কার্যালয় তৈরির ক্ষেত্রে এ আইনের প্রয়োগ করছে।

নগর ও প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক বলেন, রাজউক এবং সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতায় রাজধানী বেশ আগেই বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণের ক্ষেত্রে এসব সংস্থার ঠেলাঠেলি কোনোভাবেই সহ্য করা উচিত নয়। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতনদের এ বিষয়টি কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। এ প্রকৌশলী আরও বলেন, মাঝারি বা বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ধসে ভয়াবহ প্রাণহানির ঘটনা সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

এ প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আবদুর রহমান বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করে সিটি কর্পোরেশনকে সরবরাহ করা হয়েছে। এটা অপসারণ করার দায়িত্ব তাদের। সিটি কর্পোরেশন কেন ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণ করছে না, এ ব্যাপারে কিছু জানি না। আইন অনুযায়ী এটা সিটি কর্পোরেশনের কাজ, তাই কাজটি সিটি কর্পোরেশনকেই করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, আইনে সিটি কর্পোরেশন এবং রাজউককে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। রাজউকের পক্ষ থেকে আমাদের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণের চিঠি দেয়ার পর পাঁচবার ওই চিঠির ব্যাখ্যা দিয়ে কাজটি তাদের করতে বলা হয়েছে। তবে রাজউক আমাদের চিঠির কোনো জবাব দেয়নি।

এ ব্যাপারে ডিএনসিসির পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. তারিক বিন ইউসুফ বলেন, আইনে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণসহ বেশ কিছু কার্যক্রমের দায়িত্ব রাজউক এবং সিটি কর্পোরেশনকে দেয়ার কারণে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। কেননা একই কাজ একাধিক সংস্থা পরিচালনা করলে সমস্যা হবে। রাজউক যেহেতু অন্য সব কার্যক্রম পরিচালনা করে, সেই হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণের কার্যক্রম রাজউকেরই পরিচালনা করা উচিত।

গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, অতীতে কী ঘটেছে, তা বলতে পারব না। একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়েও লাভ নেই। নগরবাসীর স্বার্থেই ঝুঁকিপূর্ণ এবং জরাজীর্ণ ভবনগুলো অপসারণে মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে যে কোনো সময় মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে বিদ্যমান জটিলতা দূর করার চেষ্টা করব। যুগান্তর