সরকারি জমি দখল করে ৩ আবাসন কোম্পানির কংক্রিট ব্যবসা »
- প্রকাশিত :
- ১৬ জুলাই ২০১৮, সোমবার, ১১:২২:৩০

রাজধানীর পূর্বাঞ্চলে ইস্টার্ন বাইপাসের জন্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) অধিগ্রহণ করা জমি দখল করে ‘রেডিমিক্স’ কংক্রিটের কারখানা বসিয়েছে তিনটি আবাসন কোম্পানি।
পাউবো কর্মকর্তারা জানান, খিলক্ষেত থানার মস্তুল মৌজায় অধিগ্রহণ করা ৩৩ দশমিক ৫৬ একর জমির মধ্যে এনডিই রেডিমিক্স কংক্রিট ৫ একর, এবিসি বিল্ডিং প্রোডাক্ট ৩ দশমিক ৪০ একর এবং বোরাক রেডিমিক্স কংক্রিট ৪ একর জমি দখল করে নিয়েছে।
এছাড়াও ঢাকা শহর সমন্বিত বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ প্রকল্পের জন্য তুরাগ থানার গ্রাম ভাটুলিয়া মৌজায় অধিগ্রহণ করা ৫ দশমিক ৮০ একর জমি দখল করেছে এনডিই রেডিমিক্স কংক্রিট।
পাউবোর পক্ষ থেকে অবৈধ স্থাপনা সরাতে ২০১৬ সালের ১৩ জুলাই এনডিই রেডিমিক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ২০ দিনের মধ্যে অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর আবারও চিঠি দেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড।
একই দিন এবিসি বিল্ডিং কংক্রিটকে ১৫ দিনের মধ্যে এবং বোরাক রিয়েল এস্টেটকে অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
পাউবোর নথিপত্রে এই তিন কোম্পানির মালিকের নাম অজ্ঞাত লেখা রয়েছে। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এনডিই রেডিমিক্স কংক্রিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রায়হান মোস্তাফিজ। তিনি ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই) নামের আবাসন নির্মাতা কোম্পানি পরিচালক।
এবিসি বিল্ডিং প্রোডাক্টসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে রয়েছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম। বোরাক রিয়েল এস্টেটের মালিক গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করে আলোচিত শিল্পগোষ্ঠী ইউনিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহা. নুর আলী।
চিঠি দেওয়ার পরও তিন কোম্পানির কর্তৃপক্ষ অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে না নেওয়ায় দখলদার উচ্ছেদে সহায়তা চেয়ে ১৩ মে ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চিঠি পাঠায় পানি উন্নয়ন বোর্ড।
পাউবো, ঢাকার (পওর) নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আইনুল হকের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, তিনটি প্রতিষ্ঠান পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমি দখল করে রেডিমিক্স ব্যবসা করছে। দখলদারদের নোটিস দেওয়া হলেও তারা কোনো গুরুত্ব না দিয়ে অবৈধভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
আইনুল হক বলেন, “আমরা নিয়ম অনুযায়ী, দখলদারদের চিঠি দিয়েছি, থানায় জিডি করেছি। আমাদের কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নেই। এ কারণে জেলা প্রশাসনের সহায়তা চেয়েছি। ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসন একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করেছে। দখলদারদের সাতদিনের সময় দেওয়া হয়েছে। এরপর সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে।”
বুধবার মস্তুল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রাউজক পূর্বাচল প্রকল্পের ৩০০ ফুট প্রশস্ত সড়কের দুপাশে এনডিই এবং এবিসি রেডিমিক্স কংক্রিটের প্ল্যান্ট। সবগুলো প্ল্যান্টই বালু নদীর পশ্চিম পাড়ে। রেডিমিক্স কংক্রিটবাহী গাড়ি কিছুক্ষণ পরপর সেখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
এনডিইর দুটি রেডিমিক্স কংক্রিট, একটি অ্যাসফল্ট প্ল্যান্ট। এনডিইর পাশেই এবিসি বিল্ডিং প্রোডাক্ট। এবিসির পাশেই বোরাক রিয়েল এস্টেট রেডিমিক্স প্ল্যান্টের নির্মাণের জন্য জমি ভরাট করা হয়েছে। তবে এখনও সেখানে প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হয়নি।
পাউবোর অভিযোগের বিষয়ে এনডিই রেডিমিক্সের প্ল্যান্টের কোনো কর্মী কথা বলতে চাননি। পরে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী ব্যবস্থাপক ঢাকার গুলশানে তাদের প্রধান কার্যালয়ের একটি ফোন নম্বর দেন। সেখানকার মানবসম্পদ বিভাগের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শও দেন তিনি।
বৃহস্পতিবার সেই নম্বরে কল দিলে রফিক নামে একজন ফোন ধরেন। মানবসম্পদ বিভাগে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, স্যারেরা মিটিংয়ে আছেন। পরে ফোন করেন। তার কাছে ওই স্যারের মোবাইল নম্বর চাইলে তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে আবার ফোন করলেও একই কথা বলেন তিনি।
এবিসি রেডিমিক্স কংক্রিটের প্লান্টে গেলে সেখানকার ইনচার্জ হুমায়ুন কবির দাবি করেন, স্থানীয়দের কাছ থেকে জমি ভাড়া নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে অবস্থানকারী দুজনকে তিনি দেখিয়ে দেন স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে।
এর মধ্যে দেলু মিয়া নামে একজন নিজেকে মস্তুল গ্রামের বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, গ্রামের ৪০ জন বাসিন্দা এসব জমি রেডিমিক্স কোম্পানিগুলোকে ভাড়া দিয়েছেন।
“এসব জমির মালিক আমরা। জমি একোয়ার করছে অনেক বছর আগে। কিন্তু অহনো আমরা পুরা টাকা পাই নাই। জমি এখনো আমাগো দখলে আছে। আমরা তাগো কাছে ভাড়া দিছি।”
তবে অধিগ্রহণ করা জমি কীভাবে ভাড়া দিলেন, এমন প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি।
তবে অধিগ্রহণ করা জমির ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ না করার অভিযোগ খারিজ করে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আইনুল হক বলেন, “তারা আমাকেও এই কথা বলেছে। কিন্তু তারা যে ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়েছে সে কাগজপত্র আমাদের কাছে আছে।”
বিস্তারিত জানতে এবিসি বিল্ডিং প্রোডাক্টের লজিস্টিক অফিসার জাহাঙ্গীর আলম শিশিরের মোবাইল নম্বর দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন ইনচার্জ হুমায়ুন কবির।
বুধবার জাহাঙ্গীর বলেন, “আমাদের এমডি সাহেব আছেন। আপনি তার সঙ্গে একটু কথা বলে দেখেন। আমি নম্বর দিচ্ছি।”
পরে জাহাঙ্গীর আলম কোনো ফোন নম্বর দেননি, একাধিকবার ফোন করলে ফোনও ধরেননি।
একইভাবে দখলের বিষয়ে জানতে ইউনিক গ্রুপের মোবাইলে ফোন করলে এক অভ্যর্থনাকর্মী ফোন ধরে অপেক্ষা করতে বলেন।
কিছুক্ষণ পর তিনি বলেন, “আমি স্যারদের সঙ্গে কথা বলেছি। ওনারা আসলে কে কথা বলবে বিষয়টা নিয়ে,একটু কনফিউজড! আরও উপরে কথা বলতে হবে। আপনি একটু শনি-রবিবারের দিকে ফোন করেন। আজকে মনে হয় স্যারেরা এভেইলেবল না। আমি একজনকে ফোন দিয়েছিলাম। তিনি ডেস্কে নাই।”
একটু পর ইয়াহিয়া নামে আরেকজন বলেন, “ভাই, আপনার ফোন নম্বরটা দেন। আমাদের একজন সম্পাদক আছেন। তিনি এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।”
ইয়াহিয়ার পরিচয় জানতে চাইলে নিজেকে ওই প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। বিডিনিউজ২৪