
২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশিরা রাজধানীর গুলশানকে নিরাপদ এলাকা হিসেবে মনে করেন না। এর পাশাপাশি ব্যবসায় মন্দা ও রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ায় ট্রেড লাইসেন্স না দেওয়াসহ নানা কারণে রাজধানীর অভিজাত এ এলাকায় কমছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। ফলে কমছে ভাড়াটের সংখ্যা, যার প্রভাব পড়েছে ভবনের ভাড়া ও ফ্ল্যাটের দামে।
বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় রাজধানীর গুলশানে ফ্লোর ও করপোরেট অফিস ভাড়া না হওয়ার পাশাপাশি ফ্ল্যাট বিক্রিতেও সাড়া পাচ্ছে না ডেভেলপার কোম্পানিগুলো। এছাড়া রাজধানীর ঘনবসতি ও প্রতিনিয়ত যানজটের ভোগান্তির কারণে ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে মনোযোগী হচ্ছেন গ্রাহকরা।
রাজধানীতে জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়, যানজটসহ বিভিন্ন কারণে মানুষের দিন দিন ঢাকা কেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা কমছে। তাছাড়া শিক্ষা ক্ষেত্রেও এখন ঢাকার বাইরে সরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও শাখা খুলছে রাজধানীর আশেপাশে। এছাড়া গত কয়েক বছরে ঢাকায় কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মাণ হলেও যানজট নিরসনে সেগুলো ভূমিকা রাখেনি। এসবের বিকল্প চিন্তা হিসেবেই মানুষ এখন ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোয় আবাসন গড়ে তুলতে আগ্রহী হচ্ছেন। নতুন নতুন আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠছে ঢাকা-মাওয়া ও ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের পাশে। পাশাপাশি উচ্চবিত্তদের আরেকটি অংশ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, গুলশানে সাধারণত দুই শ্রেণির লোকের বসবাস উল্লেখযোগ্য- ব্যবসায়ী ও বিদেশি। বাণিজ্যিক মন্দার কারণে ব্যবসায়ীরা এখন গুলশানে আগ্রহী হচ্ছে না। গুলশানে আগে প্রচুর বিদেশি কোম্পানির লোকাল অফিস গড়ে তোলা হয়েছিল। তবে আর্টিজানের হামলার পর ওই এলাকায় বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা কমতে থাকে। এতে ডেভেলপার কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় সুবিধা করতে পারছে না। অন্যদিকে শহরের আশেপাশে জমি ক্রয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ঢাকায় ফ্ল্যাটের চাহিদা কমেছে। এছাড়া মানুষের জীবনযাত্রার মান কিছুটা উন্নত হলেও মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। ফলে আগের তুলনায় ফ্ল্যাট বিক্রি কমে গেছে।
গুলশানে ডেভেলপার কোম্পানিগুলোর কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সব বহুতল ভবনগুলো বিক্রি করতে না পাড়ায় প্রতিনিয়ত লোকশান গুনতে হচ্ছে। আর লোকশানের বোঝা কমাতে ফ্লোর বিক্রিতে মূল্য কমালেও তা বিক্রি করতে পারছে না কোম্পানিগুলো।
গুলশানে কতগুলো ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে কথা বলা হলে তারা জানায়, ‘দীর্ঘদিন ধরেই মন্দা ডেভেলপার কোম্পানিগুলোর ব্যবসা। লোকশান কমাতে মূল্যছাড় দেওয়া হলেও ভবনগুলোর ফ্লোর বিক্রি হচ্ছে না। গুলশানে আগের মতো বিদেশি অফিস হচ্ছে না। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বড় বড় ব্যবসায়ীও মুখ ফিরিয়ে অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছেন। যারা ফ্ল্যাট ক্রয় করেন তাদের বেশিরভাগই ব্যবসায়ী। যার প্রভাব পড়েছে ডেভেলপার কোম্পানিগুলোয়।
কংকর্ট গ্রুপের সেলস ম্যানেজার সুমন আহম্মেদের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘গুলশানে আমাদের বিভিন্ন রোডে পাঁচটি প্রজেক্ট রয়েছে। আগের তুলনায় ফ্ল্যাটের মূল্য কমে গেছে। একেক রোডে ফ্ল্যাটের মূল্য একেক রকম। গুলশান-১ এর ১৩৬ নম্বর রোডে আগে প্রতি বর্গফুটের মূল্য ছিল ২২ হাজার টাকা। বর্তমানে প্রতি বর্গফুটে মূল্য কমেছে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি বর্গফুটের মূল্য ২২ হাজার টাকা থেকে কমে বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার টাকায়। এছাড়া গুলশান-২ এ ৫৩ নম্বর রোডে প্রতি বর্গফুটের মূল্য ছিল ২৬ হাজার। বর্তমানে প্রতি বর্গফুটের মূল্য ২০ হাজার। অর্থাৎ প্রতি বর্গফুটের মূল্য কমেছে প্রায় ছয় হাজার। অর্থাৎ বহুতল ভবনের এ অ্যাপার্টমেন্টগুলোর মূল্য কমেছে প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। তবুও আশানুরূপ গ্রাহক নেই।
এ প্রসঙ্গে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এর সাবেক সহ-সভাপতি ও বর্তমান গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী ভূঁইয়া শেয়ার বিজকে বলেন, ‘শহরের যানজটসহ বিভিন্ন কারণে মানুষের ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে মানুষের চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে গাজীপুর, সাভার ও পূর্বাচলের দিকে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা এখন পূর্বাচলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে গুলশান, ধানমন্ডিসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাট বিক্রি কমে গেছে।’
এদিকে মফস্বল এলাকাগুলো উন্নয়নে সরকার এখন অনেক অগ্রসর। বিভাগীয় শহরগুলোয় উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। এখন জেলা পর্যায়েও অনেক উন্নয়ন হয়েছে। স্কুল, কলেজ, হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও মফস্বলে শাখা প্রতিষ্ঠা করছে। বিভিন্ন কারণেই মানুষ এখন শহরের চেয়ে নিজ গ্রামের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বলেও জানান লিয়াকত আলী।