
নান্দনিক সাজে সজ্জিত রাজধানীর হাতিরঝিলের প্রকল্প উদ্বোধনের সাড়ে পাঁচ বছর পরও স্বচ্ছ পানির দেখা পাননি দর্শনার্থীরা। বরং কাজের ফাঁকে ঘুরতে আসা বা যানজট এড়াতে ঝিলের সহজ রাস্তা ব্যবহারকারীদের বরবরই পানির তীব্র দুর্গন্ধ সহ্য করতে হচ্ছে। এ দুর্গন্ধ দূর করতে প্রকল্পের শুরু থেকে এ পর্যন্ত নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও কোনোটাই সফল হয়নি। ফলে হাতিরঝিলের নিরিবিলি পরিবেশ আর শীতল বাতাসে গা জুড়াতে হলে দুর্গন্ধ সহ্য করার কোনো বিকল্প নেই। তবে পানি শোধনের জন্য ৫০ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এ সমস্যা আর থাকবে না বলে দাবি করেছে হাতিরঝিল কর্তৃপক্ষ।
সাড়ে পাঁচ বছর আগে ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষে উদ্বোধন করা হলেও স্বচ্ছ পানির দেখা পাননি বলে অভিযোগ করেন হাতিরঝিল এলাকায় ঘুরতে আসা দর্শনার্থী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দারা। প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হয়েছে এই প্রকল্পের। অথচ কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতার কারণে আশপাশের এলাকার পচা-আবর্জনা ঝিলের মধ্যে প্রবেশ করে বছরের পর বছর ধরে নষ্ট করছে ঝিলের পানি। পানির স্বাভারিক রঙ বদলে কালচে ও সবুজ রঙ ধারণ করেছে। সে সঙ্গে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ।
তাছাড়া হাতিরঝিলে যে কয়টি পানি ঢুকার পথ রয়েছে একটি ছাড়া প্রায় সবগুলোই শোধন ক্ষমতা হারিয়েছে। ফলে আশপাশের এলাকার বজ্র্যসহ সবকিছুই প্রবেশ করছে। ঝিলের তলাদেশ দিয়ে বেশ কয়েটি ড্রেনের মাধ্যমে আশপাশের এলাকার বজ্র্য মিশ্রিত পানি ঢুকে ঝিলের পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। ফলে প্রায় সারা বছরই পানিতে কমবেশি দুর্গন্ধ হচ্ছে।
রাস্তায় তীব্র যানজট আর ঘনঘন সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের ফাঁকে একটু খোলা বাতাসে আড্ডা দেয়া বা ঘুরে বেড়ানোর জায়গা এই নগরীতে খুবই অপ্রতুল। এর মধ্যে হাতিরঝিলের নান্দনিক সৌন্দর্য্য দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করেছে। ছুটির দিন বা অবসর পেলেই ঝিলের পাড়ে বেড়াতে চলে আসেন অনেকেই। ইট-পাথরের নগর জীবনের ব্যস্ততা ভুলে একটু প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে হাতিরঝিলে ঘুরতে আসেন অনেকেই। তাদের একজন মধ্য বয়সী এক ব্যাংক কমর্কতা আমিনুর রহমান। প্রকল্পের উদ্বোধনের পর থেকে কখনো স্বপরিবারে, কখনো বন্ধুদের নিয়ে আবার কখনোবা একা একা ঝিলের পাড়ে ঘুরতে আসেন। আলাপকালে তিনি জানান, প্রায়ই পানিতে দুর্গন্ধ থাকে। কখনো কম আবার কখনো বেশি। প্রকল্পের উদ্বোধনের পর থেকে নিয়মিতই ঝিলের পাড়ে আড্ডা দেন। শুরুতে এত গন্ধ ছিল না। এ পযর্ন্ত ঝিলে কখনো স্বচ্ছ পানি দেখতে পাননি। বরং উটকো দুর্গন্ধে বিরক্ত হয়েছেন বারবার। এ দুর্গন্ধ না থাকলে ঝিলের পাড়ে বেড়াতে আরও ভালো লাগত। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়া যেত বলে জানান তিনি।
এদিকে যানজটময় রাজধানীর যাতায়াত ব্যবস্থায়ও হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস সার্ভিস কিংবা ওয়াটার ট্যাক্সি সর্ব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু পানির দুর্গন্ধের কারণে এসব পরিবহনে যাতায়াতের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন যাত্রীরা। বিশেষ করে পানির দুর্গন্ধের কারণে ওয়াটার ট্যাক্সির যাত্রী কমতে শুরু করেছে। অনেক সময় নাক চেপে বসে থাকতে দেখা যায় যাত্রীদের। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেকেই।
মগবাজার থেকে প্রতিদিন গুলশানে অফিস করেন বেসরকারি চাকরিজীবী রনি আহমেদ। তিনি জানান, সড়ক পথে দীর্ঘ যানজটের কারণে সম্প্রতি ওয়াটার ট্যাক্সি দিয়ে যাতায়াত করেন। এতে যানজট থেকে রেহাই পাওয়ার পাশাপাশি ঝিলের পানিতে ভেসে বেড়ানোর আনন্দও উপভোগ করা হয়। কিন্তু বর্ষা শেষ হলেই পানির তীব্র গন্ধে যাতায়াত করা কঠিন হয়ে পড়ে। আগের মতো যাত্রীদের ভিড়ও থাকে না। পর্যাপ্ত সংখ্যক যাত্রী না হলে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে হয়। পানির দুর্গন্ধ আর অপেক্ষার যন্ত্রণায় এখন আর ওয়াটার ট্যাক্সিতে যেতে চান না তিনি।
গত শুক্রবার হাতিরঝিলের ওয়াটার ট্যাক্সিতে চড়েন আরিয়ান আবরার। গন্তব্য গুলশান। ছুটির দিনে বন্ধুকে নিয়ে শখের বসে ওয়াটার ট্যাক্সিতে তার প্রথম ওঠা হলেও বিরক্ত নিয়ে বাড়ি ফেরেন। পানির উৎকট গন্ধ তাদের পুরো জার্নির গল্প হয়ে ওঠে। তার ভাষ্যে, পানির দুর্গন্ধে পুরো আনন্দ মাটি হলো।
আরিয়ানের মতো স্বচ্ছ পানির বুকে ভেসে বেড়ানোর আনন্দ পেতে ওইদিন ওয়াটার ট্যাক্সিতে চড়েছিলেন আরেক ভ্রমণপিয়াসী তরিকুল ইসলাম। বাড্ডার এ বাসিন্দা নিয়মিত হাতিরঝিলের ‘চক্রাকার বাস’ দিয়ে যাতায়াত করেন। তবে শখের বসে সেদিন দুই সন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু হাতিরঝিলের পানির দুর্গন্ধ ঠেকাতে তারা নাকে কাপড় চেপে রেখেছিলেন। তাই ভালো করে হাতিরঝিলের সৌন্দয্য উপভোগ করতে পারেনি তারা। তাদের মতো অনেক দর্শনার্থীর মধ্যেই পানির দুর্গন্ধ নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, হাতিরঝিলের এফডিসি মোড় অংশ থেকে লেকের মধুবাগ ব্রিজ পর্যন্ত পানির রঙ কালচে আর সবুজ বর্ণের। সে সঙ্গে রয়েছে ভয়াবহ দুর্গন্ধ। তাছাড়া ঝিলের পানিতে দর্শনার্থীদের ফলের খোসা এবং চানাচুর ও চিপসের প্যাকেট ভাসতে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, বৃষ্টিতে বাইরের এলাকার শিল্প বজ্র্য ভেসে আসে। প্রকল্পের চারপাশে গড়ে ওঠা ছোট-বড় অনেক দোকান ও রেস্তোরাঁর ময়লা-আবজর্নাও পানিতে ফেলা হয়। সে সঙ্গে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে লেকের পাড় ঘেঁষে জমানো ময়লার স্তুপ থেকেও প্রতিদিন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আর তার খেসারত দিচ্ছেন পথচারী, দর্শনার্থী এবং আশপাশের বাসিন্দারা। তবে এফডিসির অংশের লেকের প্রবেশমুখেই আবর্জনার স্তুপ ও মনুষ্য মলমূত্রের দুর্গন্ধ তুলনামূলক বেশি। পানির রঙ সচরাচর স্বাভাবিক বা স্বচ্ছ দেখেন না আশপাশের বাসিন্দারা। কখনো কালো কুচকুচে বা সবুজ রঙের পানি থেকে প্রায়ই দুর্গন্ধ আসতে থাকে।
অন্যদিকে তিন মাস আগে পানির দুর্গন্ধ রোধ ও ময়লা শোষণ করতে ঝিলের পানিতে ভাসমান ট্রে তৈরি করে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। পরীক্ষামূলক এ কার্যক্রমটি এফডিসির অংশে করা হলেও কাঙ্খিত ফল পেলে পুরো লেকজুড়েই ভাসানোর পরিকল্পনা ছিল কর্তৃপক্ষের। তবে এতে কাঙ্খিত ফল না পাওয়ায় ঝিলের পানির দুর্গন্ধ রোধ এবং পরিশোধনের জন্য নতুন একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে হাতিরঝিল প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। তাছাড়া প্রকল্পের শুরু থেকে পানি শোধন ও দুর্গন্ধ দূর করতে নানা কার্যক্রম পরিচালনা করলেও সুফল মেলেনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাতিরঝিল প্রকল্পের এক কর্মকর্তা জানান, নিমার্ণ কাজের সময় বিভিন্ন সেবা সংস্থা যে যার কাজ সম্পন্ন করলেও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ হাতিরঝিলে পানি প্রবেশের সব পথ পয়োবজ্র্যমুক্ত করতে আলাদা পয়োনালা নির্মাণ করেনি। যার কারণে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও পানি নিয়ে অস্বস্তিতে সবাই।
এ প্রসঙ্গে আলাপকালে হাতিরঝিল প্রকল্পের পরিচালক ও রাজধানী উন্নয়ন কতৃর্পক্ষের (রাজউক) তত্তাবধায়ক প্রকৌশলী জামাল আক্তার ভুঁইয়া বলেন, হাতিরঝিলের সঙ্গে মহাখালী, মগবাজারের টঙ্গী ডাইভারশন রোড, মধুবাগ, বেগুনবাড়ি, নিকেতন, তেজগাঁও, বাড্ডা ও রামপুরায় এলাকায় দশটি সংযোগ আছে। যেগুলো দিয়ে আশপাশের এলাকার বৃষ্টির পানিসহ ময়লা পানি, পয়োবজ্র্য ও শিল্পবজ্র্য এসে পড়ছে ঝিলে। তাছাড়া পান্থপথ, কাওরানবাজার ও কাঁঠালবাগান এলাকার পানির ড্রেন ও স্যুয়ারেজ লাইন একসঙ্গে যুক্ত থাকায় ওইসব এলাকার শিল্প বজ্র্য, বাসাবাড়ির ময়লা পানিসহ সব ধরনের পচা-বাসি পানি হাতিরঝিলের পানিতে মিশছে। ফলে ঝিলের পানিও স্বচ্ছতা হারাচ্ছে। বর্ষায় পানির দর্গন্ধ আরও প্রকট হয়ে ওঠে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্গন্ধ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে পরিশোধনের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ৫০ কোটি টাকার নতুন একটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা করেছে রাজউক।
হাতিরঝিল প্রকল্প কর্মকর্তা মেজর সাদিক শাহরিয়ার বলেন, হাতিরঝিলের পানির দুর্গন্ধ রোধে ইতোমধ্যে ঝিলের পানিতে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। এসব গাছের মধ্যে কলাবতী ও ঘাসজাতীয় গাছের সংখ্যা বেশি। কাঙ্খিত ফল পেলে লেকজুড়েই ভাসানো হবে এসব গাছ। পাশাপাশি পানির দুর্গন্ধ রোধ এবং পরিশোধনের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা পর্যায়ে রয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হলে পানি পরিশোধনের কাজ শুরু হবে। যাযাদি