
কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনে স্পষ্ট বলা আছে যে, কৃষি জমি অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। যদি অন্য কাজে ব্যবহার করা হয় তাহলে ওই জমি সরকারের অধীনে ন্যস্ত হবে। এই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) মাস্টার প্ল্যানের আওতাধীন এলাকায় গড়ে উঠছে একের পর এক অনুমোদনহীন আবাসন প্রকল্প।
বাহারি সাইনবোর্ড আর বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে এসব প্রকল্পের জমি কিনতে আকৃষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ। অপরিকল্পিতভাবে আবাসন প্রকল্প গড়ে ওঠায় পরিবেশ বিপর্যয়সহ নানা ধরনের সমস্যার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) পরিকল্পনা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগর ছাড়াও অনেক এলাকা কেডিএ’র মাস্টার প্ল্যানের আওতায় রয়েছে। ১৯৬১ সালে ১৮১ বর্গ কি.মি. এলাকা নিয়ে বৃহত্তর খুলনা শহরের প্রথম মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তীতে ২০০১ সালে সংশোধিত খুলনা মাস্টার প্ল্যানের এলাকার অধিক্ষেত্র ৪৫১.১৮ বর্গ কি. মিটারে উন্নীত করা হয় এবং বর্তমান সরকারের আমলে খুলনা শহরকে মোংলা পর্যন্ত বর্ধিত করে অতিরিক্ত ৩৭৩.৪৩ বর্গ কি.মি. এলাকা মাস্টার প্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে বর্তমানে ৮২৪.৬১ বর্গকিলোমিটার এলাকা পরিকল্পিত নগরায়নের আওতায় এসেছে। এছাড়া নগরের উত্তরে যশোরের নওয়াপাড়া পৌর এলাকার উত্তর সীমানা। পূর্বে রূপসা উপজেলার সম্পূর্ণ অংশ ও পশ্চিমে ডুমুরিয়া উপজেলার কৈয়া বাজার পর্যন্ত এলাকা। এসব এলাকার মধ্যে কোনো ধরনের আবাসিক প্রকল্প গড়ে তুলতে কেডিএ’র অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু এসব এলাকার কোনো আবাসন প্রকল্প আজ পর্যন্ত কেডিএ থেকে অনুমোদন নেয়নি। এসব এলাকায় ১শর কাছাকাছি আবাসন প্রকল্প বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের ভেতরে ৫ একর এবং সিটি কর্পোরেশনের বাইরে ১০ একর জমি থাকার বিধান থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানের জমি রয়েছে নামমাত্র। যদিও অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানগুলো দেদারছে প্লট বিক্রি করছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, আইন লঙ্ঘন করে কেডিএ’র আওতাধীন এলাকায় হানিফ মোহাম্মদ আবাসন প্রকল্প, সবুজ সিটি আবাসন প্রকল্প, মোহাম্মাদীয়া আবাসন প্রকল্প, খানজাহাননগর আবাসন প্রকল্প, আরাফাত আবাসন প্রকল্প, স্বপ্নগড়ি আবাসিক প্রকল্প, মাদানীনগর, রৌশনীবাগ আবাসিক এলাকা, রাজদীপ, ন্যাশনাল, গুলজান সিটি, সবুজবাংলা আবাসন প্রকল্প, মহানগর আবাসন প্রকল্প, অর্পিতা হাউজিং প্রকল্প, সুস্মিতা আবাসন প্রকল্প, মোল্লা প্রোপার্টিজ, বিশ্বাস প্রোপার্টিজ, মাদানী সোসাইটি, সিয়াম হাউজিং প্রকল্প, ফাতেমা আবাসিক প্রকল্প, স্বপ্নপুরি আবাসিক এলাকা, প্রগতি আবাসন, বনলতা আবাসিক এলাকা, হোসেন আবাসন প্রকল্প, শিকদার আবাসিক প্রকল্প, সততা আবাসন, কাদের হাউজিং প্রকল্প, বিসমিল্লাহ ট্রেডার্স অ্যান্ড কন্সট্রাকশন, আদর্শ পল্লী আবাসিক এলাকা, আশিকনগর, সাউদ বাংলা, শান্ত নীড় হোল্ডিং রিয়েল এস্টেট প্রকল্প, যুবক হাউজিং রিয়েল এস্টেট নামে নগরীর সোনাডাঙ্গা, রূপসা, হরিণটানা ও লবণচরা এলাকায় বেশ কিছু আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া এসব এলাকায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক অনেক আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে। যারা কিছু জমি কিনে বা নিজের নামে পাওয়ার নামা করে আবাসিক প্লটিং ব্যবসা করছে। এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মানুষকে আকৃষ্ট করতে ব্যবহার করছেন বাহারি সাইনবোর্ড এবং প্যানা, ফেস্টুন। এসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের কাছে ২, ৩, ৫, ৭ ও ১০ কাঠার প্লট বিক্রি করছে। এসব প্রকল্পের কেডিএ’র অনুমোদন আছে কিনা, তা না জেনেই প্লট কিনছেন।
প্রগতি আবাসন প্রকল্পের মোঃ মিজান জানান, আবাসন প্রকল্পে কেডিএ’র অনুমোদন লাগে না শুধু কেডিএ থেকে এনওসি নিলে হয়। সেটি করে দিতে আমরা সহায়তা করবো। আমাদের লোক রয়েছে আমরা ব্যবস্থা করে দেব।
বসুপাড়া বাঁশতলা এলাকার ব্যাংক কর্মকর্তা মোঃ সাদেকুল ইসলাম জানান, আমি ৫-৬টা খুব ভাল মানের আবাসন প্রকল্পের অফিসে গিয়েছি প্লট কেনার জন্য। কিন্তু তাদের কোনো জমি আবাসনের নামে নেই। রয়েছে ব্যক্তির নামে। কেডিএর অনুমোদনও নেই।
‘কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন ২০১৫’ নামে একটি আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। খসড়ায় বলা হয়েছে, দেশের সব কৃষি জমির ওপর কৃষক বা কৃষিজীবীদেরই অধিকার থাকবে। কৃষিজমি যে কেউ কেনাবেচা করতে পারবেন না। এ ছাড়া কৃষি জমি শুধু কৃষি কাজেই ব্যবহার করতে হবে। এই জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হলে ওই জমির মালিকানা সরকারের অধীনে ন্যস্ত হবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক ড. দিলীপ দত্ত বলেন, অপরিকল্পিত আবাসন প্রকল্পের কারণে ভবিষ্যতে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। যেভাবে খাল, বিল ও জলাশয় ভরাট করে প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে তাতে স্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে।
কেডিএ’র অথরাইজড অফিসার ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অঃদাঃ) এবং তথ্য কর্মকর্তা শামীম জেহাদ জানান, রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০ অনুযায়ী আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলতে কেডিএ’র অনুমোদন নিতে হবে। এরপর ট্রেড লাইসেন্স (ব্যবসার অনুমতিপত্র), করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) ও মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) নিবন্ধন নম্বর, ব্যাংক সলভেন্সি, অফিস এবং কর্মকর্তা কর্মচারী লাগবে। এই আইন অমান্য করলে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা ৩ বছরের জেল অথবা উভয় দ-ে দ-িত হতে পারেন।