
বাড়ি তৈরির জন্য এবার দেশের সচ্ছল কৃষকদের ঋণ দিতে যাচ্ছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স করপোরেশান (বিএইচবিএফসি)। এ ঋণের পরিমাণ হবে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা, আর সুদের হার ৮ শতাংশ। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ৫ থেকে ২৫ বছর।
কৃষকদের বাড়ি থৈরির ঋণ দিতে বিএইচবিএফসির পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেয় ২০১৭ সালের ৩১ মে। ৮ মাস পর গত ফেব্রুয়ারিতে এ বিষয়ে অনুমোদন দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এরও ৮ মাসের মাথায় বিএইচবিএফসি সম্প্রতি ‘কৃষক আবাসন ঋণ কর্মসূচি’ নামে নীতিমালা তৈরি করে।
বিএইচবিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেবাশীষ চক্রবর্তী গত বৃহষ্পতিবার বলেন, আগামী ১ অক্টোবর থেকেই কর্মসূচিটি চালু করা হবে। নীতিমালায় কৃষকদের সংজ্ঞা, কৃষকের জমি, ঋণের ধরণ, ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা, ঋণের পরিমাণ, কিস্তি পরিশোধের সময় ইত্যাদি তুলে ধরা হয়েছে।
নীতিমালা অনুযায়ী, কৃষক বলতে বোঝানো হয়েছে যিনি নিজের জমিতে নিজ অথবা তার পরিবারের সদস্য বা শ্রমিক নিয়ে চাষাবাদ করেন অথবা অন্যের কাছ থেকে ইজারা (লিজ) নিয়ে জমি চাষাবাদ করেন অথবা যিনি অন্যের জমিতে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। আর কৃষকের জমি বলতে তার নিজের জমি, অন্যের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া জমি এবং কৃষকের আবাসিক বসবাসের জমিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
কৃষকদের বাড়ি তৈরির জন্য দুই ধরনের ঋণ দেবে বিএইচবিএফসি। একক ঋণ ও গ্রুপ ঋণ। বাড়ি তৈরির জন্য জমি থাকতে হবে উপজেলা সদর, সদরের আশপাশে উপশহর অর্থাৎ শহর ও গ্রামের মাঝামাঝি কোনো অঞ্চল এবং গ্রোথ সেন্টার। গ্রোথ সেন্টার হচ্ছে গ্রামের যে অঞ্চলে কোনো হাটবাজার গঞ্জ ইত্যাদি গড়ে উঠেছে।
নিরক্ষর কৃষকও ঋণ পাবেন
নাম দস্তখত করতে জানেন না, এমন নিরক্ষর কৃষককেও ঋণ দেয়া হবে। সে ক্ষেত্রে ঐ কৃষকের পরিবারের সদস্যরা থাকবেন জামিনদার। এমনকি নিজের অপারগতায় কোনো কৃষক যদি কাউকে আমমোক্তার নিয়োগ (পাওয়ার অব এ্যাটর্নি) করেন, তিনিও ঋণ পাবেন।
তবে যে এলাকায় বাড়ি হবে, ঋণের আবেদনকারীকে সেই এলাকায় বাড়ি হবে, ঋণের আবেদনকারীকে সেই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে এবং যেকোনো তফসিলি ব্যাংকে তার একটি সঞ্চয়ী হিসাব থাকতে হবে। ঋণের জন্য কৃষকের বয়স হতে হবে ১০-৬০ বছর এবং কিস্তি পরিশোধের যৌক্তিক সামর্থ্য থাকতে হবে তার। আবার যে বাড়ি হবে, সেই বাড়িতে যাতায়াতের জন্য ভালো রাস্তাঘাট থাকতে হবে। বাড়িটি তৈরি করতে হবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের করা প্ল্যান অনুযায়ী।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, আদালতের মাধ্যমে দেউলিয়া ঘোষিত ব্যক্তি ঋণ পাবেন না। আবার ইতিমধ্যে কোনো ঋণের জামিনদার থাকলে তিনিও পাবেন না ঋণ। যে জমির উপর বাড়ি হবে, সেই জমি দায়মুক্ত হতে হবে। পরিত্যক্ত সম্পত্তির বিপরীতে এবং জমির যথাযথ দলিল না থাকলেও ঋণ পাবেন না কেউ। একই এলাকায় কোনো কৃষকের পাকা বাড়ি থাকলে তিনি নতুন করে ‘কৃষক আবাসন ঋণ’ পাবেন না।
বাণিজ্যিক কাম আবাসিক ভবন
প্রধানত আবাসিক ভবন তৈরির জন্যই কৃষকদের ঋণ দেওয়া হবে। ক্ষেত্র বিশেষে ঋণ দেওয়া হবে বাণিজ্যিক কাম আবাসিক ভবন তৈরির জন্যও। তবে এ ক্ষেত্রে ঋণের প্রথম কিস্তি নেওয়ার আগেই ভবনের বাণিজ্যিক অংশ নিজের টাকায় তৈরি করতে হবে।
তবে এক পরিবার একবারই ঋণ পাবে। স্বামী বা স্ত্রীর ক্ষেত্রে একক নামে বা যৌথ নামে ঋণ চাইলে যেকোনো একজনের নিজস্ব আয় থাকতে হবে। তবে তাদের কেউ কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আগে ঋণ নিয়ে থাকলে আর নতুন করে ঋণ পাবেন না।
ভবন তৈরির জন্য যে নকশা করা হবে, তাতে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে ঋণ পাওয়া যাবে না। নদী ভাঙনের ঝূঁকিপূর্ণ এলাকায় ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করবে বিএইচবিএফসি। তবে সংশ্লিষ্ট এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কমপক্ষে নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে ‘প্রস্তাবিত বন্ধকি জমি নদীভাঙনের ঝুঁকিপূর্ণ নয়’ মর্মে ছাড়পত্র পাওয়া গেলে ঋণের জন্য আবেদন বিবেচিত হতে পারে।
প্রথম কিস্তির টাকা পাওয়ার আগেই জমি ‘নিবন্ধিত বন্ধক’ রাখতে হবে বিএইচবিএফসিতে, বন্ধকি নিবন্ধনের খরচ গ্রাহককেই বহন করতে হবে।
নিজের টাকাও থাকতে হবে
একক ঋণের পরিমাণ সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা। আর গ্রুপ ঋণের ক্ষেত্রে গ্রুপে যতজন থাকেন, প্রত্যেকের জন্য রয়েছে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা করে। একক ও গ্রুপ- উভয় ক্ষেত্রেই ঋণের সুদ ৮ শতাংশ। ঋণের মেয়াদ হবে ৫,১০,১৫,২০,২৫ বছর।
তবে ভবন তৈরিতে যত টাকা লাগবে, তার পুরোটাই বিএইচবিএফসি দিবে না, দেবে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। অর্থাৎ ভবন তৈরিতে যদি মোট ১ লাখ টাকা লাগে, তাহলে ২০ টাকা হলেও নিজের থাকতে হবে কৃষকের, বাকি ৮০ হাজার টাকা পাওয়া যাবে ঋণ। আবার কৃষকের নিজস্ব বিনিয়োগ ও ঋণের টাকা মিলিয়ে মোট যে টাকা দাঁড়াবে, জমির মূল্য হতে হবে তার দ্বিগুণ।
যেসব কাগজপত্র লাগবে
নীতিমালায় বলা হয়েছে, একক ঋণের আবেদনপত্রের সঙ্গে জমির মুল দলিল, নামজারির খতিয়ান, হাল সনের খাজনা রসিদ ও জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত ফটোকপি জমা দিতে হবে। এ ছাড়া সিএস, এসএ, আরএস ও বিএস খতিয়ানের জাবেদা নকল, সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে ১২ বছরের নির্দায় সনদ লাগবে। গ্রুপ ঋণের ক্ষেত্রে লাগবে ফ্ল্যাট বন্টন চুক্তিির দলিল।
অন্যদিকে লাগবে মাটির গুণাগুণ পরীক্ষার (সয়েল টেস্ট) প্রতিবেদন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী অভিজ্ঞ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ভূমিকম্প প্রতিরোধী সনদ, আবেদনকারী ও জামিনদারের আয়ের সনদ।
এছাড়া লাগবে ঋণ আবেদনকারী ও জামিনদারের আয়ের হলফনামা, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছ থেকে নেওয়া আয়ের সনদপত্র, আয়কর পরিশোধযোগ্য আয় থাকলে আয়কর পরিশোধের প্রত্যয়নপত্র ইত্যাদি।
কৃষকের কিছু প্রশ্ন
নামে ‘কৃষক আবাসন ঋণ কর্মসূচি’ করা হলেও প্রকৃত কৃষক এ ঋণ পাবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। নীতিমালাটিও অস্পষ্ট অর্থাৎ কৃষকবান্ধব নয়। নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলার ইব্রাহিমপুর গ্রামের কৃষক শাহজাহান মিয়ার কাছে নীতিমালার মূল বিষয়গুলো তুলে ধরলে তিনি জানান, ‘প্রকৃত কৃষক কোনোভাবেই এ ঋণ পাবেন না। আমার মনে হয়, কৃষকদের দেওয়ার জন্যও এ নীতিমালা করা হয়নি। এর সুবিধাভোগী হবে অন্যরা’।
শাহজাহান মিয়া আরও বলেন, কৃষক বসবাস করেন গ্রামে। নীতিমালা অনুযায়ী ঋণ নিতে গেলে গ্রাম ছেড়ে কৃষককে শহরে গিয়ে বাড়ি করতে হবে। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ থেকে নেয়া প্ল্যান অনুযায়ী বাড়ি করার কথা বলা হলেও কর্তৃপক্ষ বলতে সরকারের কোনো সংস্থাকে বোঝানো হয়েে, তা স্পষ্ট নয়। এছাড়া ভূমিকম্পরোধী সনদ,মাটির গুণাগুণ পরীক্ষার প্রতিবেদন ইত্যাদি শর্ত জুড়ে দিয়ে কৃষকদের এই ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
কৃষক শাহজাহান মিয়ার কথা বেদাশীষ চক্রবর্তীতে জানালে তিনি বলেন, ‘এই ঋণ দিতে কৃষি ব্যাংকের কাছ থেকে কৃষকদের তালিকা নেওয়া হচ্ছে। আর নীতিমালায় সংশোধনী আনাও কোনো কঠিন কাজ নয়।’