পৃথিবীকে এখনই ‘কার্বন–নিরপেক্ষ’ করতে না পারলে সর্বনাশ আর ঠেকানো যাবে না। মাত্র ১২ বছরের মধ্যে আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী শেষ হয়ে যেতে পারে বলে আবারও সাবধান করে দিয়েছে ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (আইপিসিসি)। কার্বন–নিরপেক্ষ হওয়া মানে প্রকৃতি থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ ও ত্যাগের মধ্যে একটা সমতা রাখা। প্রতিবেদন বলছে, অদূর ভবিষ্যতেই মারণ তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হতে হবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়াসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় নানা দেশ আর দ্বীপরাষ্ট্রকে। ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গির মতো রোগ বাড়বে। গরমে আক্ষরিক অর্থেই ধুঁকবে মেগাসিটিগুলো, যার মধ্যে সবার আগে থাকছে ঢাকা–কলকাতার মতো শহরগুলো।
৯ অক্টোবর সোমবার জাতিসংঘের বিবেচনার জন্য পেশ করা এক প্রতিবেদনে আইপিসিসি তাদের নানা তথ্য আর আলামতের প্রমাণ দিয়ে বেশ জোর দিয়ে জানিয়েছে, সময় একদম নেই। আইপিসিসির মতে, প্যারিস সমঝোতার (২০১৫) পর এখনো এমন কিছু ঘটেনি, যাতে আশার আলো দেখা যাবে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার জেরে পরিস্থিতি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইমেট রিসার্চ প্রোগ্রামের প্রধান এবং আইপিসিসি প্রতিবেদনের মূল লেখক মাইলস অ্যালেনের মতে, কার্বন–নিরপেক্ষতা অর্জন করতে হলে পৃথিবীর বর্তমান মোট জিডিপির ২.৫ শতাংশ বিকল্প শক্তি গবেষণা ও উৎপাদনে বিনিয়োগ করতে হবে। টাকার অঙ্কে সেটা হবে প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার। এ ছাড়া কমাতে হবে গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরির সব প্রক্রিয়া। জোর দিতে হবে ভূ–প্রকৌশল (জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং) জলবায়ু প্রকৌশলে। কমাতে হবে নানা ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার।
২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি সইয়ের আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়া পর্যন্ত পৃথিবী নিরাপদ। কিন্তু আইপিসিসি এবার বলছে, সামগ্রিকভাবে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা এখনই গত ১৫০ বছরের তুলনায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এটাই সব বিপৎসীমা ছাড়ানোর জন্য যথেষ্ট। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেই বেঁধে রাখতে হবে। কিন্তু বর্তমানে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা যে হারে বাড়ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতেই তাপমাত্রা ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। আইপিসিসি সম্প্রতি পরিচালিত প্রায় ছয় হাজার বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে তাদের প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। প্রতিবেদনটি আগামী ডিসেম্বরে পোল্যান্ডের কাটোউইসে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের বিবেচনার জন্য পেশ করা হবে। যুক্তরাষ্ট্র আবারও হয়তো বিযুক্ত থাকবে, কিন্তু অন্যদের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।
আমাদের হাতে আছে আর মাত্র ১২টা বছর! এখনই আমাদের জীবনযাত্রা, ভোগবিলাস আর কৃষি-শিল্প-জ্বালানি নীতির খোলনলচে বদলিয়ে বড়সড় পরিবর্তন আনতে হবে, রাশ টানতে হবে ভোগবাদী জীবনচর্চায়। সে কাজটা সময়মতো করতে না পারলে ২০৩০ সালের মধ্যেই ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাবে আরও ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাতে, ক্রান্তীয় অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রতলের উচ্চতা বাড়বে, যা ডেকে আনবে প্লাবন। বিপন্ন হবে বদ্বীপ ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলো। পরপর ঝড়–জলোচ্ছ্বাস–সুনামি আছড়ে পড়বে বিভিন্ন প্রান্তে।
এবারের প্রতিবেদনে ভূ-প্রকৌশল বা জলবায়ু প্রকৌশলের ওপর নতুন মাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু কী সেই পদ্ধতি? বাতাস থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইড শুষে নিয়ে তা থেকে জ্বালানি প্রস্তুত করা বা মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া। পদ্ধতিটি বেশ খরচসাপেক্ষ। কিন্তু আমাদের একটামাত্র পৃথিবীকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংকট থেকে বাঁচাতে হলে খরচের কথা ভাবলে চলবে কি? অবস্থা এখন এমনই যে, হয় খরচ করো না হয় খরচ হয়ে যাও। আণবিক বোমা, মহাকাশযাত্রা, যুদ্ধের নানান মারণাস্ত্র তৈরি বন্ধ করে অতি সহজেই এই টাকার জোগান দেওয়া সম্ভব।
অন্য সব বিকল্প ব্যবস্থার মধ্যে বিজ্ঞানীরা বৃক্ষরোপণের ওপর আবার ব্যাপক জোর দিয়েছেন, বলেছেন বাঁচাতে হবে জঙ্গল। বাড়াতে হবে জৈব জ্বালানির ব্যবহার। তাঁর বলেছেন আখ, গম, ভুট্টার মতো বায়োফুয়েল চাষ বাড়ালে উপকার হবে। আইপিসিসির কো-চেয়ার এবং লন্ডনের সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল পলিসির অধ্যাপক জিম স্কেয়া একটু হতাশার সুরে বলেছেন, ‘আমরা আমাদের কাজ করেছি। এখন বাকিটা যাঁরা দেশ চালান তাঁদের কাজ।’
বাংলাদেশে আমরা সুন্দরবনকে বাজি ধরে কয়লানির্ভর শক্তি উৎপাদনে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছি। কুইক রেন্টালের চিমনিগুলো কী হারে কার্বন নিঃসরণ করছে, তা আমরা জানি না। চিনিকলে তালা ঝুলিয়ে আখ উৎপাদন লাটে ওঠাচ্ছি। এসব পদক্ষেপ পৃথিবীর মুরব্বিদের কার্বন নিঃসরণের তুলনায় অতি সামান্য, হয়তো হিসেবে কণামাত্র; কিন্তু তারপরেও আমাদেরও হুঁশের সঙ্গে চলা উচিত।