আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
বিশেষ খুদে বাসা: অকল্পনীয় উদ্যোগ

‘আমি চাই দেশের প্রত্যেক নাগরিক একখণ্ড ভূমি ও তার ওপর একটি বাড়ির মালিক হবেন। সেটা অবশ্য প্রচলিত ধারণার বাড়ি নয়। হতে পারে একটি বিশেষ আলাদা বাড়ি অথবা একটি ফ্ল্যাট এবং অনেক বাড়ির সমন্বয়ে একটি বিশেষ আবাসন উদ্যোগ; যেখানে প্রত্যেক নাগরিক এই বিশেষ আবাসনের ধরনের জন্য সংকট মুহূর্তে সেবার নিশ্চয়তা পাবেন। আবার যাঁর সংগতি নেই, তিনিও হবেন কমপক্ষে ৭ ফুট বাই ৩ ফুট একটি বেডের জায়গার মালিক। সেটাই হবে তাঁর “স্পেশাল মাইক্রো হাউস” বা বিশেষ খুদে বাসা। সেটা হয়তো একটা বড় বহুতল দালানের বিভিন্ন ফ্লোরের ঘরে পাশাপাশি কয়েকটি বেডের জায়গার একটি। সেই ২১ বর্গফুট ছোট্ট বাসার মালিকানার পাকা দলিল থাকবে। সেই সঙ্গে সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাদানকারীরা থাকবেন, নিয়মিত দেখাশোনা করবেন। সাধারণ অসুখ–বিসুখে চিকিৎসার ব্যবস্থাও থাকবে। থাকবে নিয়মিত সেবা মনিটরিং। আর থাকবে পূর্ণ নিরাপত্তা। এই সবকিছু তার খুদে বাড়ির মালিকানার অন্তর্ভুক্ত।’

একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে দম নিলেন শেলিনা আক্তার। তিনি সুবার্তা ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক। মাত্র আট বছর আগে এই ট্রাস্ট গঠন করেন। ঢাকার শ্যামলীতে নিজেদের পৈতৃক বাড়ির জমিতে অবস্থাপন্নদের জন্য একটি মডেল তৈরি করেছেন; যেটি কিনে নিচ্ছেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও ডক্টররা। এটির নাম দিয়েছেন ‘স্বপ্নলোক পিস ভ্যালি ১’। এ ছাড়া নেত্রকোনায় তৈরি করছেন অসচ্ছলদের জন্য স্পেশাল মাইক্রো হাউজিং; নাম ‘স্বপ্ন বাড়ি ১’। খুলনা, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জে আরও তৈরি করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে তাঁদের স্বপ্নলোক পিস ভ্যালি-২ প্রকল্প। কয়েক দিন আগে সেখানে যাই। কথা হয় শেলিনা আক্তারের সঙ্গে।

শেলিনা আক্তার মানুষের সক্রিয় জীবনকে দুই ভাগে ভাগ করে দেখেন। প্রথম জীবনে একজন ব্যক্তি কাজ করে জীবিকা অর্জন করেন। একসময় তাঁর কর্মক্ষমতা কমে গেলে তাঁর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু। তিনি কিন্তু তখন হালকা কাজ ও আনন্দময় অবসর কাটাতে পারেন। এই সময় তাঁর দরকার একটি নিশ্চিন্ত আবাস ও সেবাপদ্ধতি। যার বৈধ মালিক হবেন তিনি এবং উপভোগ করবেন তাঁর সম্পদের চূড়ান্ত রূপকে।

কিন্তু যিনি খুব গরিব, চালচুলো নেই, তিনি কীভাবে এ রকম কোনো আবাসের মালিক হবেন? শেলিনা বলেন, এটা সম্ভব। তিনি জীবনের প্রথম অধ্যায়ে প্রতিদিন যদি এক টাকা করেও ট্রাস্টে জমা করেন, মাত্র ২০ মাসেই তিনি অন্তত ২১ বর্গফুটের জায়গার মালিক হবেন। যদি সেটাও সম্ভব না হয়, তিনি ট্রাস্টে কাজ করতে পারেন। সেখান থেকে সামান্য উপার্জন তিনি জমিয়ে অন্তত একটা খুদে বাড়ির জায়গার মালিক হতে পারেন। এটা খুবই সম্ভব।

কখনো আরও টাকা জমিয়ে তিনি দু-চার-দশটা খুদে বাড়ির মালিক হতে পারেন। এটা তাঁর ভবিষ্যতের সঞ্চয়। তাঁর আবাসের পাকা দলিল থাকবে। হঠাৎ টাকার দরকার হলে তিনি দু-চারটা খুদে বাড়ি বিক্রি করে দিতে পারেন। বাড়ি কেনাবেচাও তাঁর জীবনে সমৃদ্ধি এনে দিতে পারে।

তিনি হয়তো কর্মজীবনে সেখানে থাকবেন না। সেই সময় তিনি তাঁর বাসা অন্যকে ভাড়া দিতে পারেন, যাদের বিশেষ সেবার প্রয়োজন হবে। অথবা কাউকে বিনা ভাড়ায় থাকতে দিতে পারেন। কিন্তু বাসার মালিক তিনি। হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনায় অসুস্থ বা অচল হয়ে গেলে তিনি নিজের বাসার ঠিকানায় থাকবেন। তাঁকে রাস্তায় বেওয়ারিশ পড়ে থেকে মরতে হবে না।

মোটকথা, প্রত্যেক নাগরিকের নিজের মালিকানায় একটা বিশেষ বাসাবাড়ি থাকবে। সেটা বড় হোক বা ছোট। এমনকি সেটা যদি একটা ৭ ফুট বাই ৩ ফুট বেডের জায়গাও হয়। তাও সে শান্তিতে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচবে। কারণ, সেটা তো শুধু একটা বেডের জায়গা নয়। সেই সঙ্গে থাকবে সেবাশুশ্রূষা, চিকিৎসা, ফিজিওথেরাপি, পুষ্টিকর খাদ্যব্যবস্থাসহ সব নিরাপত্তা ও সামান্য সামর্থ্যের মধ্যেও তাঁর কর্মপ্রচেষ্টা ও বেঁচে থাকার স্বপ্ন।

একটা বাসার মালিকানা, সেটা যত খুদেই হোক, তিনি সেটার মালিক। এই মালিকানাবোধ তাঁকে অসামান্য জীবনীশক্তি দেবে এবং আত্মনির্ভরশীল হিসেবে মর্যাদাবান করবে।

কারও ছেলেমেয়ে বা পরিবারের সদস্যদের পক্ষে তাঁকে দেখাশোনা করা যদি সম্ভব না-ও হয়, তা–ও তিনি কিন্তু অকূলপাথারে ভাসবেন না। মর্যাদার সঙ্গে নিজের বাসায় থেকে, সেবাশুশ্রূষা নিয়ে তিনি মাথা উঁচু করে বাঁচবেন।

প্রশ্ন হলো এই যে বিশেষ খুদে বাড়ির মধ্যে এত সুযোগ-সুবিধা, সেটা কীভাবে সম্ভব? শেলিনা বলেন, বিভিন্ন জেলায় জমি দিতে মানুষ আগ্রহী হচ্ছেন; সেখানে বহুতল ভবন তৈরি হবে। ফ্লোরে ফ্লোরে খুদে বাসা তথা বেড তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, গার্মেন্টস কোম্পানির মালিকেরা প্রতিবছর বিভিন্ন সেকশনের সেরা কর্মীদের অন্তত একটি করে বেড তাঁদের নামে কিনে দিতে পারেন। সেটা হবে তাঁদের সিএসআর কার্যক্রমের অংশ। বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের শ্রমিকদের জন্য এ ধরনের সিএসআর হাউজিং অ্যাওয়ার্ড কর্মসূচি হাতে নিতে পারে।

শেলিনা আক্তার মনে করেন, এটা প্রচলিত ধারণার বৃদ্ধাশ্রম বা ওল্ড হোম নয়। তিনি একে বলেন ইন্টিগ্রেটেড কেয়ার সেন্টার বা সমন্বিত সেবাকেন্দ্র। এখানে তিনি নিজের বাসায় থাকবেন, সেবা ও চিকিৎসা পাবেন—একজন মানুষ হিসেবে এটা তাঁর ন্যায্য পাওনা। এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে।

এই প্রকল্পের জন্য দরকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাকর্মী। যাঁরা প্রবীণ বা কোনো কারণে অল্প বয়সে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন তাঁদের দেখাশোনা, সেবাযত্ন করবেন। কেউ হয়তো বাসায় পরিবারের সঙ্গেই আনন্দে থাকতে পারেন। কিন্তু তাঁর একজন সেবাকর্মী দরকার। এই ধরনের সেবাকর্মী প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, এটা একটা ইন্ডাস্ট্রি বা সেবা খাত হিসেবে অচিরেই দাঁড়িয়ে যাবে। কারণ, সমাজে এর চাহিদা আছে।

শেলিনা আক্তার বলেন, স্কুলের বইয়ে ‘সেবাবিদ্যা’ বা কেয়ারোলজি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা দরকার। একেবারে ছোটবেলা থেকেই সবাই সেবার মনোভাব নিয়ে গড়ে উঠবে।

আবার আপনি হয়তো বেশ সচ্ছল। ঢাকায় দু-একটা বাড়ি আছে। ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকে। রোজই ফেস টাইমে কথা হয়। কিন্তু তারপরও মন মানে না। বিদেশে ছেলেমেয়ের কাছে গিয়ে যে থাকবেন, সেটাও আপনার পছন্দ না। কারণ, সেখানে তো আপনাকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকতে হবে। কী করবেন? আবার ঢাকায় যে থাকবেন, তারই বা উপায় কী? কে আপনার সেবাযত্ন করবে? যত্ন নেওয়ার কর্মী হয়তো নিয়োগ দিতে পারবেন, কিন্তু সারাক্ষণ নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে থাকতে হবে।

তাই আপনি হয়তো কর্মজীবনেই সুবার্তা ট্রাস্টে, নগরজীবনের কোলাহল থেকে দূরে গ্রামীণ পরিবেশে, প্রকৃতির মাঝে একটা দুই রুমের ফ্ল্যাট ২০-৩০ লাখ টাকায় কিনে রেখেছেন। মাঝখানে অন্যদের থাকতে দিয়েছেন ভাড়ায় বা বিনা ভাড়ায়। তারপর একসময় স্বামী-স্ত্রী সেখানে গেলেন নিজেদের নিকুঞ্জে। সেখানে আপনার সেবাযত্ন, খাওয়া, চিকিৎসা সব ব্যবস্থা আছে। আপনার চিন্তার কোনো দরকার নেই।

অথবা আপনি কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, ডাক্তার। শেষ বয়সে সেখানে উঠুন। নিশ্চিন্তে সেখানে কবিতা লিখুন, গল্প-উপন্যাস লিখুন, শিক্ষা দিন, সেবা দিন। মনে হবে নতুন এক জীবন নিয়ে আপনি নিসর্গে আছেন।

শেলিনা আক্তার চোখেমুখে কথা বলেন। তাঁর স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করবেনই। সমাজে যাঁরা প্রতিষ্ঠিত, আসুন আমরা এই অচিন্তনীয় স্বপ্ন সফল করতে তাঁর পাশে দাঁড়াই। প্রআ