রাজধানী ঢাকাকে একটি আধুনিক ও বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে ২০ বছর মেয়াদি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রণয়ন করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক। এরই মধ্যে প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এলাকার মিশ্র ব্যবহারকে প্রাধান্য দিয়ে সিএস ও আরএস জরিপ অনুযায়ী খাল, জলাশয় ও নদী উদ্ধার এবং সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে আমূল উন্নয়ন হওয়া এলাকা থেকে ভেটারমেন্ট ফি আদায়সহ জোনভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো নতুন ড্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে রাজধানী ঢাকা পরিকল্পিত, বাসযোগ্য ও আধুনিক নগরী হবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।
রাজউকের পরিকল্পনা অনুযায়ী, চলতি বছরের জুনের মধ্যে নতুন ড্যাপ চূড়ান্ত করা হবে। এজন্য দু’টি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটি ড্যাপ প্রণয়নে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। পাশাপাশি প্রকল্পের আওতাধীন এলাকার সংসদ সদস্য, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র, পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, পরিবেশবিদ, এনজিও, সুশীল সমাজসহ সকলের মতামত ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে ড্যাপ প্রণয়ন করা হচেচ্ছ। এজন্য এ যাবত ১৩০টি অংশগ্রহণমূলক সভা, ৮৩০টি লিখিত মতামত গ্রহণ এবং এক হাজার ৩০টি প্রশ্নমালা দিয়ে জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ তিন দফায় বৃদ্ধি করার পর খসড়া প্রণয়ন পর্যায়ে রয়েছে। এই তালিকা প্রকাশের পর পত্রিকা ও ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে নাগরিকদের কাছে আরও বিশদ মতামত চাওয়া হবে। এরপর চূড়ান্ত ড্যাপের গেজেট প্রকাশ করা হবে।
এর আগেও একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে রাজউকের আওতাভুক্ত ৫৯০ বর্গমাইল (এক হাজার ৫২৮ বর্গ কিলোমিটার) এলাকার জন্য ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান (১৯৯৫-২০১৫) এবং আরবান এরিয়া প্ল্যান (১৯৯৫-২০০৯) এর পলিসির আলোকে সমগ্র রাজউক এলাকার জন্য ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়। সর্বশেষ ২০১০ সালের ২২ জুন চূড়ান্ত ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এর মেয়াদ ধরা হয় ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত।
কিন্তু প্রণীত ওই ড্যাপে নানা অসঙ্গতি দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে এটি ছিল বাস্তবতা বিবর্জিত। ড্যাপ প্রণয়নকারীরা গোগল ম্যাপ দেখেই ওই ড্যাপ প্রণয়ন করাসহ নানা অভিযোগ ওঠার পর এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ড্যাপের গেজেট প্রকাশের মাত্র ৫দিন পর বিশদভাবে ড্যাপ পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত করতে ২০১০ সালের ২৭ জুন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ৭ জন মন্ত্রীকে নিয়ে একটি ‘মন্ত্রিসভা কমিটি’ গঠন করে দেওয়া হয়। এই কমিটিকে ড্যাপ রিভিউ কমিটিও বলা হয়ে থাকে। পরবর্তীতে আবারও ড্যাপ সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফলে বাস্তবে রূপ পায়নি ওই পরিকল্পনা।
গেজেট আকারে ড্যাপ প্রকাশের পর বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে ভূমি ব্যবহারসংক্রান্ত প্রস্তাবনা পুনর্বিবেচনার জন্য রাজউকে ২ হাজার ১৪৭টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে ৫২৫টি আবেদন মন্ত্রিসভা কমিটিতে উত্থাপন হলে কমিটি ১১১টি আবেদন অনুমোদনের বিষয়ে সুপারিশ করে।
বর্তমানে সংশোধিত ড্যাপ (২০১৬-৩৫) প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। সংশোধিত ড্যাপ কার্যকর হওয়ার সঙ্গে পুরনো ড্যাপ বাতিল হয়ে যাবে। এর আগে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় রাজউক রিভাইজড ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান (২০১৬-২০৩৫) প্রণয়ন করা হয়েছে। এই প্ল্যানের আলোকে ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (২০১৬-৩৫) প্রণয়ন করা হচ্ছে।
রাজউক সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের মার্চে সংশোধিত ড্যাপ প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। প্রথমে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত ড্যাপের কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু পরে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। এই সময়েও ড্যাপ প্রণয়নের কাজ শেষ করতে না পারায় জুন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধির প্রস্তাব করে রাজউক। প্রকল্প কর্মকর্তা জানান, নির্ধারিত এই সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
সূত্র জানায়, ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (২০১৬-৩৫) প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- ইনসেপশন, সার্ভে, ইনটেরিম, খসড়া পরিকল্পনা ও চূড়ান্ত পর্যায়। বর্তমানে এর চতুর্থ ধাপ খসড়া পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে চূড়ান্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে বলে জানিয়েছে রাজউক।
প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিটি এলাকায় আবাসিকের পাশাপাশি বাণিজ্যিক এলাকারও চাহিদা থাকে। এজন্য ড্যাপের মহা-পরিকল্পনায় কোনও এলাকাকে শুধু আবাসিক বা বাণিজ্যিক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে না। এজন্য এলাকাভিত্তিক মিশ্র ব্যবহারকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে বিনিয়োগবান্ধব অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে জোর সুপারিশ করা হবে। নিয়মতান্ত্রিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মূল অবকাঠামো উন্নয়ন নিশ্চিত করতে জনঘনত্ব ও স্কুল জোনিং এবং জোনভিত্তিক পুনঃউন্নয়ন পলিসি বাস্তবায়নের সুপারিশ ও নীতিমালা করা হবে। পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য সিএস ও আরএস জরিপ অনুযায়ী যেসব এলাকায় নদী, খাল ও জলাশয় রয়েছে সেগুলো পুনরুদ্ধারের সুপারিশ করা হবে। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে সম্পদের দাম বৃদ্ধি পাওয়া এলাকা থেকে ভেটারমেন্ট ফি আদায়ের সুপারিশ করা হবে। হাঁটার পরিবেশ নিশ্চিত করতে মেট্রো স্টেশন কেন্দ্রিক কানেকটিভিটির সুপারিশ ও নগরায়ন উন্নয়নের জন্য সেবাকেন্দ্রের ব্যবস্থাসহ আরও নানা বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
জানতে চাইলে রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সংশোধিত ড্যাপ প্রণয়ন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের জনপ্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়া হয়েছে। নগরে বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিরসনের জন্য নগর পুনঃউন্নয়ন, জনঘনত্ব জোনিং, জোনভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনাসহ নানা কৌশল নতুন ড্যাপে অন্তর্ভুক্ত করেছি। বর্তমানে খসড়া প্রণয়ন পর্যায়ে রয়েছে। চলতি বছরের জুনের মধ্যে চূড়ান্ত ড্যাপ প্রণয়ন করা হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ঢাকা মহানগরীসহ রাজউক এলাকাভুক্ত এলাকায় পরিকল্পিত নগরায়নে ড্যাপ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বাংলা ট্রিবিউন