আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
গ্রাহকের ৫০ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা আবাসন কোম্পানি

‘ট্রাস্ট অ্যালায়েন্স’ বা ‘বিশ্বাসের জোট’ নাম নিয়ে মানুষের ‘বিশ্বাস’কে পুঁজি করে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট বিক্রির নামে প্রতারণা করেছে নামসর্বস্ব আবাসন কোম্পানি ট্রাস্ট অ্যালায়েন্স টেকনোলজি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার রইস উদ্দিন আহমেদ ও নূরানা আহমেদ দুজনই উচ্চশিক্ষিত। সেই সুবাদে ফ্ল্যাট বিক্রির নাম করে অভিজাত শ্রেণির শতাধিক গ্রাহকের প্রায় ৫০ কোটি টাকা নিয়েছে। এরপর সুযোগ বুঝে লাপাত্তা হয়েছে ওই দম্পত্তি। আর প্রতিষ্ঠানটির মালিকরা লাপাত্তা হওয়ার পর কয়েক বছর ধরনা দিয়েও ফ্ল্যাট বুঝে পাচ্ছেন না ভুক্তভোগী গ্রাহকরা। অন্যদিকে ওই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি করে জমির মালিকরাও ভোগান্তির মুখে পড়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৯ সালে আবাসন ব্যবসা শুরু করেন খন্দকার রইস উদ্দিন আহমেদ। তা স্ত্রী নূরানা আহমেদও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তার সঙ্গে ছিলেন। ট্রাস্ট অ্যালায়েন্স টেকনোলজি লিমিটেডের নামে আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যার) সদস্যপদ নেয়। বারিধারা, গুলশানসহ রাজধানীর অভিজাত এলাকায় আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ফ্ল্যাট বিক্রির নামে গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ শুরু করে। ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সর্বনিন্ম ৫০ লাখ টাকা থেকে তিন কোটি পর্যন্ত অগ্রিম নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার খন্দকার রইস উদ্দিন আহমেদ প্রায় ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে তথ্য মিলেছে।
এক-দুই বা দশজন নন। জমির মালিক-ফ্ল্যাট ক্রেতা মিলিয়ে কয়েকশ মানুষ ট্রাস্ট অ্যালায়েন্স টেকনোলজি লিমিটেডের প্রতারণার শিকার। ভুক্তভোগীর তালিকায় বাংলাদেশের ক্রিকেটের অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের নামও রয়েছে। তার কাছ থেকেও দুই কোটি ৬৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কোম্পানিটি।
সূত্রমতে, শুরুতে রাজধানীর গুলশান এভিনিউয়ের সুবাস্তু ইমাম টাওয়ারের সপ্তম তলায় ট্রাস্ট অ্যালায়েন্স টেকনোলজি লিমিটেডের অফিস ছিল। রিহ্যাবের সদস্যপদ নেওয়ার জন্যও ওই ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। এরপর দফায় দফায় অফিসের ঠিকানা বদল হয়েছে। এখন প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। রিহ্যাবের সদস্যপদ নেওয়ার সময় মার্কেটিং ম্যানেজার মোহাম্মদ নাসিম আবদুল্লাহ রহমানকে প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও তার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এদিকে বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত দুটি সেলফোন নম্বরের একটি বন্ধ পাওয়া গেছে। অন্যটিতে যোগাযোগ করা হলে মার্কেটিংয়ের সাবেক কর্মকর্তা রাসেল মাহমুদ ২০১৭ সালের শেষদিকে চাকরি ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন বলে জানান। একইভাবে রিহ্যাবসহ অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া প্রতিষ্ঠানটির টেলিফোন নম্বরগুলোও এখন বন্ধ। একাধিক প্রকল্পের ঠিকানায় যোগাযোগ করে সেখানে ট্রাস্ট অ্যালায়েন্স টেকনোলজির কোনো প্রকল্প খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে সঙ্গে গুলশান-১, মহাখালী ডিওএইচএস ও মতিঝিলসহ একাধিক ঠিকানায় যোগাযোগ করেও ওই প্রতিষ্ঠানের সন্ধান মেলেনি।
২০১৭ সালের ২৯ জুলাই ট্রাস্ট অ্যালায়েন্স টেকনোলজি লিমিটেডের ফেসবুক পেজে বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নুসরাত আফরীন নাজ লিখেছেন, ‘এটি একমাত্র ব্যক্তিনির্ভর প্রাইভেট কোম্পানি, যেখানে শুধুমাত্র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা-ই সবকিছু করার ক্ষমতা রাখেন। আবাসন প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন প্রকল্পের ফ্ল্যাট ক্রেতাদের মতো জমির মালিকরাও ভুগছেন। সিইও’র কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না, তিনি ফোনও ধরছেন না। কোম্পানির অধিকাংশ কর্মকর্তা চাকরি ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে গেছেন। তাদের ছয় মাসের বেশি বেতন বকেয়া রয়েছে। রিহ্যাবের সদস্য হলেও জমির মালিকদের ভোগান্তি দূর করতে তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’
ওই স্ট্যাটাসের কমেন্টে শিরিন সুলতান নামের আরেক ভুক্তভোগী ফ্ল্যাট ক্রেতা লিখেছেন, ‘আমি একটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য তাদের সঙ্গে চুক্তি করেছি। দুই বছর আগে অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তর করার কথা ছিল, কিন্তু এখনও কোনো খবর নেই। আমি সিইও পর্যন্ত পৌঁছতে পারছি না, তিনি কারও ফোন ধরেন না। তারা অফিসও অন্য একটি আবাসিক এলাকায় সরিয়ে নিয়েছেন। পুরোনো প্রায় সব কর্মকর্তাই চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। টাকা ফেরত চাইলে অন্য কারও কাছে ফ্ল্যাট বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত টাকা দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানাচ্ছেন। আর ফ্ল্যাট স্যারেন্ডার করতে হলেও আমার কাছ থেকেই ক্ষতিপূরণ চাইছে। আমি জানি না কীভাবে এই ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাব।’
আলাপকালে রিহ্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলী ভুঁইয়া শেয়ার বিজকে বলেন, ‘প্রতারণা-ভোগান্তি এড়াতে আমরা প্লট-ফ্ল্যাট কেনাকাটায় গ্রাহকদের সতর্ক থাকার অনুরোধ করছি। কিন্তু তারপরও জটিলতা এড়ানো যাচ্ছে না। কিছু কোম্পানির মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। ট্রাস্ট অ্যালায়েন্স টেকনোলজির সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে। যেহেতু সদস্যপদ নেই, তাই রিহ্যারের পক্ষ থেকে কোনো কিছু করার সুযোগ নেই। ভুক্তভোগীরা চাইলে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ফ্ল্যাট ক্রেতা আলাপকালে বলেন, ‘আমি বারিধারায় আট কোটি টাকায় ফ্ল্যাট কেনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হই। চুক্তি অনুযায়ী এক কোটি টাকা দিয়েছি। দুবছরের মধ্যে ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা ছিল। পরে চুক্তিপত্রে দেওয়া প্রকল্পের ঠিকানায় অন্য কোম্পানির প্রকল্প পেয়েছি। জমির মালিকের সহায়তায় সাইনবোর্ড লাগিয়ে আমার মতো আরও অনেকের সঙ্গে প্রতারণা করেছে ট্রাস্ট অ্যালায়েন্স। রিহ্যাবের সদস্য তালিকায় নাম দেখেই ফ্ল্যাট কিনতে গেছি। এখন কোম্পানি পালিয়ে যাওয়ার পর রিহ্যাব বলছে সদস্য নয় বলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। আমরা এখন কার কাছে যাব।’
এদিকে কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রেজিস্টার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের তথ্যমতে, ট্রাস্ট অ্যালায়েন্স টেকনোলজিসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার রইস উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী নূরানা আহমেদ ওই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সে সঙ্গে ওই দম্পতির দুই পুত্র খন্দকার ইরাদ আহমেদ ও খন্দকার ইয়াকিদ আহমেদও প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক। সেখানে দেওয়া কাগজপত্রে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা ‘১০৭, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ওই ঠিকানায় যোগাযোগ করেও ওই কোম্পানির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। শেয়ার বিজ