দেশের অভ্যন্তরে পণ্য বিক্রি করে তা রফতানি দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় রড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টিল রিরোলিং মিলসের (বিএসআরএম) বিরুদ্ধে।
প্রতিষ্ঠানটি আইন ও বিধিবহির্ভূতভাবে প্রত্যর্পণ নিয়ে প্রায় ১১০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট কমিশনারেটের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
ইতোমধ্যে বিধিবহির্ভূতভাবে প্রত্যর্পণ নেয়া এ রাজস্ব রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে বিএসআরএম-কে চিঠি দিয়েছে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট শাখা। তবে এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে শীর্ষস্থানীয় রড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানটি। মামলাটি বর্তমানে উচ্চ আদালতে চলমান।
এনবিআর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১১০ কোটি টাকা রাজস্ব দাবির বিষয়ে আদালতে উপযুক্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হবে। মামলা নিষ্পত্তি হতে আরও মাসখানেক সময় লাগতে পারে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, ‘বিএসআরএম কোম্পানি তাদের এমন কিছু লেনদেনকে রফতানি হিসেবে দেখাচ্ছে যা রফতানি শ্রেণিভুক্ত নয়। রফতানি পণ্য হিসেবে গণ্য হতে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ হতে হয়, বিএসআরএম সেসব শর্ত পূরণ না করে কয়েক দফায় প্রায় ১০৬ কোটি টাকা প্রত্যর্পণ নিয়েছে। এছাড়া ভ্যাট পরিশোধ করেনি আরও চার কোটি টাকা, যা আইন ও বিধিবহির্ভূত।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রত্যর্পণ নেয়া এ রাজস্ব রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে বিএসআরএম-কে চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা বিষয়টি আদালতে সমাধানের চেষ্টা করছেন। বর্তমানে মামলাটি উচ্চ আদালতে হেয়ারিংয়ে আছে। আশা করছি মাসখানেকের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি হবে।’
মোহাম্মদ এনামুল হক আরও জানান, ২০১৬-১৮ সাল পর্যন্ত চার-পাঁচ দফায় প্রত্যর্পণ ও ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে বিএসআরএম। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে পণ্য বিক্রি করে বিএসআরএম ওই লেনদেনগুলোকে রফতানি হিসেবে দেখিয়েছে। যেমন- পদ্মা সেতু, কর্ণফুলি টানেল, লাকসাম-আখাউড়া ডুয়েল গেজ রেললাইন প্রকল্প এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামে নির্মিত বিভিন্ন ফ্লাইওভার।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৬ সালের জুন-ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএসআরএম প্রায় আড়াই হাজার টন পণ্য সরবরাহের বিপরীতে শুল্ককর প্রত্যর্পণ নিয়েছে তিন কোটি ৫৬ লাখ টাকা, আর ভ্যাট পরিহার করেছে ১৪ লাখ টাকা।
২০১৭ সালে দুই ধাপে প্রায় ১০ হাজার টন পণ্য সরবরাহের বিপরীতে শুল্ককর ও ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ১২ কোটি টাকার ওপরে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি-নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ৮৯ হাজার টন পণ্য সরবরাহের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি শুল্ককর প্রত্যর্পণ নিয়েছে ৯১ কোটি টাকা। আর ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে তিন কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
সবমিলে প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহ করা পণ্য ‘রফতানি বলে গণ্য’ দেখিয়ে ১০৬ কোটি টাকার শুল্ককর এবং চার কোটি টাকার ভ্যাট পরিশোধ করেনি।
সূত্র জানায়, বৈদেশিক অর্থায়িত বিভিন্ন প্রকল্পে এভাবে পণ্য সরবরাহ করে রফতানি বলে গণ্যের সুবিধার আওতায় আনছে বেশকিছু কোম্পানি। পরে এ বিষয়ে এনবিআরের ভ্যাট নীতি শাখা থেকে একটি ব্যাখ্যা সব কমিশনারেটে পাঠানো হয়। কিন্তু সে ব্যাখ্যা মানতে রাজি নয় বিএসআরএম।
বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেডের অর্থ ও হিসাব বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ও কোম্পানি সচিব শেখর রঞ্জন কর বলেন, ‘বিদেশি অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পে পণ্য সরবরাহ করে শুল্ককর প্রত্যর্পণের এ বিষয়টি গত ২৫ বছর ধরে চলে আসছে। এনবিআর হঠাৎ করে এমন দাবি করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এরই মধ্যে এনবিআর থেকে এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, কিন্তু সে ব্যাখ্যা বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’
স্থানীয় পর্যায়ে রফতানি বলে গণ্য পণ্যের বিপরীতে রাজস্ব আদায়ের বিষয়ে জটিলতা দেখা দেয়ায় গত বছরের শেষদিকে এনবিআরের মূসক আইন ও বিধি শাখা থেকে দেয়া ব্যাখ্যায় বলা হয়, ‘বিদেশি মুদ্রায় বাস্তবায়নের জন্য নির্ধারিত কোনো প্রকল্প সম্পাদনে আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ নিয়ে যদি দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ পায়, তাহলে তারা এ প্রত্যর্পণ পাবে।’
‘কিন্তু দরপত্রে কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়ে যদি পণ্য সরবরাহের জন্য দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানকে তারা সরবরাহকারী নিয়োগ দেয়, তাহলে তারা এ ধরনের প্রত্যর্পণ পাবে না।’
রড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টিল রিরোলিং মিলসের (বিএসআরএম) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মধ্যে যেসব ক্ষেত্রে প্রত্যর্পণ নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে সেখানে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক দরপত্রে কাজ পেয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠান। আর ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্য সরবরাহ করছে বিএসআরএম। নিয়ম অনুযায়ী তাই তারা প্রত্যর্পণ পাওয়ার যোগ্য হবে না।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, ‘কোনো পণ্য রফতানি বলে গণ্য হতে হলে সেক্ষেত্রে বেশকিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। প্রথমত, এ সুবিধা পেতে বিষয়টি আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে কাজ পেতে হবে। দ্বিতীয়ত, পণ্য সরবরাহের বিপরীতে প্রাপ্য অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে আসতে হবে। তৃতীয়ত, সকল লেনদেন বৈদেশিক মুদ্রায় হতে হবে। চতুর্থত, পণ্য চালান কীভাবে কোন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণে এনবিআরের প্রতিনিধি থাকা বাধ্যতামূলক। এর বাইরেও আরও অনেক প্রক্রিয়া রয়েছে, যা বিদ্যমান মূসক বিধিতে উল্লেখ রয়েছে।’
কিন্তু এসব প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে একটি প্রতিষ্ঠানে পণ্য সরবরাহ করে যদি কেউ শুল্ককর প্রত্যর্পণ দাবি করে, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এছাড়া এ ধরনের কাজ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রাথমিক যে ঠিকাদার তারা একবার প্রত্যর্পণ নিয়েছেন। ওই ঠিকাদার কাউকে সাব-কন্ট্রাক্টর নিয়োগ দিলে তারাও যদি প্রত্যর্পণ দাবি করেন, তাহলে বিষয়টি দুবার এসে যায়। যেহেতু এটি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে, আমরা আদালতে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যাখ্যা দেব- বলেন মোহাম্মদ এনামুল হক।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিদ্যমান মূল্য সংযোজন কর আইনের ২(শ) ধারা ও মূল্য সংযোজন কর বিধিমালার ৩১ (ক) বিধি মোতাবেক কোনো প্রতিষ্ঠান উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রফতানি করলে শুল্ক, কর ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট অব্যাহতি পায়। তবে দেশের অভ্যন্তরে বিদেশি অর্থায়নে (ফরেন কারেন্সি) বাস্তবায়িত নির্দিষ্ট কোনো প্রকল্পে পণ্য বিক্রি করলেও সেক্ষেত্রে রফতানির সুবিধা নেয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে মূল দরপত্রে সরবরাহকারী হিসেবে নাম উল্লেখ থাকতে হবে।
বিএসআরএম স্টিল এ ধরনের প্রকল্পে দেশের অভ্যন্তরে পণ্য সরবরাহ করে শুল্ককর প্রত্যর্পণ নিয়েছে, কিন্তু প্রকল্পের মূল ঠিকাদার হিসেবে তারা তলিকাভুক্ত নয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পেয়েছে বিদেশি প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্য সরবরাহ করছে বিএসআরএম। সুতরাং তারা এ ধরনের প্রত্যর্পণ পাওয়ার যোগ্য হবে না। জাগো নিউজ