আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
আবাসন প্রতিষ্ঠানের নামে ৩শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক প্রতিষ্ঠান

আবাসন প্রতিষ্ঠানের নামে কথিত ব্যবসা খুলে একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে কমপক্ষে তিনশ কোটি টাকা। তাদের মূল টার্গেট বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অধিক লাভের আশায় অনেকে জীবনের শেষ সম্বল তুলে দিচ্ছেন তাদের হাতেই।

সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির কোনো অনুমোদন নেই। তার পরও বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় অফিস খুলে গত দেড় বছর ধরে দেদার ব্যবসা করছে প্রতিষ্ঠানটি। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে প্রায় ১৭শ একর জমি কেনা আছে দাবি করা হলেও অনুসন্ধানে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানাধীন ৫০ একর জমিরও অস্তিত্ব মেলেনি। এমন প্রেক্ষাপটে তারা দুই সহস্রাধিক সদস্যের কাছে প্লট বিক্রির নামে তাদের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু কাউকেই জমি বা প্লট বুঝিয়ে দিতে পারেনি।

‘পূর্বাচল মডেল স্যাটেলাইট টাউন লিমিটেড’ ও ‘মেগা স্যাটেলাইট সিটি লিমিটেড’ নামে এই প্রতারণার জাল বুনেছে চক্রটি। বনানীর ই ব্লকের ১৯/এ নম্বর রোডের ২২ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায় করপোরেট অফিস রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। তবে অন্য কোনো আবাসন প্রতিষ্ঠানের অফিসের মতো যে কেউ চাইলেই সেখানে ঢুকতে পারেন না। ওই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্রতিনিধির মাধ্যমে অফিসে ঢুকতে হয়। নিজেদের বিনিয়োগকারীদের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখতে এই কৌশল চক্রটির।

এ কৌশলের কারণেই এ প্রতিবেদকের পক্ষে প্রথমদিন ওই অফিসে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি; ফিরে আসতে হয় নিরাপত্তাকর্মীদের বাধার মুখে। পরে ভিন্ন মাধ্যমে তাদের নির্দিষ্ট প্রতিনিধির মাধ্যমে যোগাযোগ করে কয়েক দফায় ওই অফিসে যাওয়া সম্ভব হয়।

সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন কক্ষে সাজানো চেয়ার টেবিলে আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের বোঝানো হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির দুজন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেনÑ এখানে জমি বা প্লটে বিনিয়োগ করতে হবে একটু ভিন্নভাবে। মানে এখানে বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফা ও জমি দুটো একসঙ্গে মিলবে। এমএলএমে দ্রুত সদস্য সংগ্রহে জ্যামিতিক হারে জাল ছড়ানোর যে পদ্ধতিটি রয়েছে, এখানেও তেমন একটি পদ্ধতি বোঝানো হয় এ প্রতিবেদককে।

কর্মকর্তারা বলেন, প্রতি কাঠা জমি সাত লাখ টাকায় ‘কেনা’ও যাবে। মানে এটাকে তারা ক্রয় না বলে বলছেন ‘বিনিয়োগ’। এই বিনিয়োগ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি মাসে এক লাখে ছয় হাজার টাকা করে মুনাফা দেবে প্রতিষ্ঠানটি। এভাবে ১৬ মাস মুনাফা দেওয়ার পর বিনিয়োগকারী চাইলে মূল টাকা ফেরৎ নিতে পারেন অথবা কাঠা প্রতি ৭ লাখ টাকা দিয়ে জমিও নিতে পারবেন, উল্লেখ করেন ওই দুই কর্মকর্তা। তারা জানান, ইতোমধ্যে প্রায় তিন হাজার সদস্য তাদের প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে প্রায় সবাই বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মাঠ পর্যায়ের সদস্য। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই সাবেক সেনা সদস্য।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এ প্রতিষ্ঠানে যারা ‘বিনিয়োগ’ করেন, তাদের যারা নিয়ে আসেন, সেই সূত্রধরদের ১০ শতাংশ হারে কমিশন দেয় প্রতিষ্ঠনটি। তার ওপর আবার বিনিয়োগকারীকে প্রতি মাসে ৬ শতাংশ হারে মুনাফার টাকা দিয়ে ১৬ মাস শেষে জমি দেওয়ার টাকা থাকা সম্ভব কিনা এই প্রশ্ন খোদ প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পদে থাকা এক কর্মকর্তারও। বিনিয়োগকারীদের নানাভাবে লভ্যাংশের প্রলোভন দেওয়া হলেও পুরোটাই শুভঙ্করের ফাঁকি। প্রতিষ্ঠানটির রাজউক কিংবা জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন নেই।

প্রতিষ্ঠাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছে শাহরিয়ার জয়, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. রানা, পরিচালক (অর্থ) রেজাউল করিম ও তার স্ত্রী ডিএমডি পিংকি আক্তার, পরিচালক সাইদুর রহমান সাইদ এবং পরিচালক মো. কামাল। তাদের মধ্যে শাহরিয়ার জয় ছাড়া বাকি সবাই এর আগে বিভিন্ন সময় আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে বন্ধ হয়ে যাওয়া নিউওয়ে, নিউলাইফের মতো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় যুক্ত ছিলেন। প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের সবার বিরুদ্ধেই।

সরেজমিন অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের আগলা, বাগলা ও রাহেলা গ্রাম তিনটিতে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছেন কথিত এই আবাসন প্রতিষ্ঠানটি। পরিচয় গোপন করে জমির ক্রেতা হিসেবে এই প্রতিবেদক সেখানে গেলে গ্রামের মানুষ জড়ো হন। তারা জানান, জমি না কিনে মালিকের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছেন পূর্বাচল মডেল স্যাটেলাইট টাউন লিমিটেড। সামান্য কিছু জমি কিনেছেন। বছরভিত্তিক নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ভাড়া পরিশোধ করেন তারা। গ্রামের জলাশয়, খালেও সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে জমি কেনার কথা জানানো হলে গ্রামের বয়স্ক ব্যক্তিরা এক প্রকার ক্ষেপে যান। তারা এ প্রতিবেদককে বলেন, আপনারা জমি কেনার জায়গা পান না। এই বাটপারদের কাছ থেকে জমি কিনবেন? ওদের জমি আছে এখানে কতটুকু? ঢাকায় তারা ১ হাজার ৭০০ বিঘা জমি এখানে কেনার কথা প্রচার করলেও তারা উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, এখানে তাদের বড় জোর ২০ বিঘা জমি আছে?

এসব দুর্র্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহরিয়ার জয় আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমাদের কাগজপত্র নাই। কিন্তু রিডিম পূর্বাচল সিটির সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসা করছি।’ তাদেরও অনুমোদন নেই জানানো হলে তিনি বলেন, ‘আপনি দেখা করেন। সব কাগজপত্র দেখাব।’

এর পর শাহরিয়ার জয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি নিজে না এসে তার একজন বন্ধুকে পাঠান। ওই বন্ধু এই প্রতিবেদকে বলেন, ‘আপনার অনুসন্ধান ঠিক আছে। সে (বন্ধু) বলেছে পরিবেশ অধিদপ্তর ও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেবে। আপাতত আপনি রিপোর্ট বন্ধ করুন। আপনার জন্য … লাখ টাকা পাঠিয়েছে। এটা রাখেন। এ ছাড়া এই এই সমস্যা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত প্রতি মাসে আপনাকে ৫০ হাজার টাকা করে দেবে বলেছে।’ পুরো কথপোকথনের রেকর্ড রয়েছে এ প্রতিবেদকের হাতে।

প্রতিষ্ঠানটি মাত্র দেড় বছর শুরু করলেও তাদের ওয়েবসাইটে দাবি করেছে আট বছর ধরে কার্যক্রম চালানোর কথা। ১০ মিনিটের একটি ভিডিও বিজ্ঞাপন চিত্রে বিলাসবহুল আবাসিক এলাকার কাল্পনিক চিত্র দেখিয়ে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করছে চক্রটি। ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দুবাই, কানাডা, নেপালেও তাদের আবাসন প্রকল্প রয়েছে বলে বিজ্ঞাপন ও ওয়েব পোর্টালে প্রচার চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও চলছে জোর প্রচার।

টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল শুরু হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ওপর নাখোশ ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের এক কর্মী আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের প্রতিদিনের টাকার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রেখে বাকি টাকা সবাই ভাগ করে নিয়ে যান। শুধু অন্য কমিশন দিতে কত টাকা লাগবে সেটি হিসাব করে রেখে বাকি টাকা নিয়ে যান ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের কর্মকর্তারা।’

জানা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা প্রশাসনের ঘাটে-ঘাটে মাসোহারা প্রদান করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

অভিজাত এলাকায় অফিস খুলে প্রকাশ্যে প্রতারণা করলেও এখনো প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বনানী থানার ওসি ফরমান আলী আমাদের সময়কে বলেন, এমন অফিস আমাদের থানা এলাকায় চালানোর বিষয়টি জানা ছিল না। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আস