আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
নকশাবহির্ভূত ভবন কত জানে না রাজউক

ভবন নির্মাণে মানা হচ্ছে না বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি)। অনুমোদিত নকশার বাইরে গিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন। যদিও ঢাকায় অনুমোদিত নকশার বাইরে গিয়ে ঠিক কতগুলো ভবন নির্মিত হয়েছে, তা জানা নেই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)।

ঢাকার বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ভবনটির নকশা অনুমোদনে বিধি লঙ্ঘন এবং নির্মাণে ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানসহ ৬২ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছিল গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এর পরই টনক নড়ে রাজউকের। ত্রুটি-বিচ্যুতি অনুসন্ধানে রাজধানীতে নির্মিত বহুতল ভবনগুলো পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয় সংস্থাটি। তবে ১ হাজার ৮১৮টি ভবন পরিদর্শনের পর থেমে গেছে সে উদ্যোগ। গত নভেম্বরের পর থেকে রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালত আর কোনো অভিযান পরিচালনা করেননি। ফলে কার্যক্রমটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। তাই ঠিক কতগুলো ভবন অনুমোদিত নকশার বাইরে গিয়ে নির্মিত, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি রাজউক।

জানা গেছে, রাজউকের ২৪টি দল ১ হাজার ৮১৮টি ভবন পরিদর্শনের পর ১ হাজার ৪৭টি ভবনে বিভিন্ন ধরনের ব্যত্যয় খুঁজে পেয়েছিল। এছাড়া অনুমোদিত নকশা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন ৪৭৮টি ভবনের মালিক। এরপর পরিদর্শনে নির্মাণ ত্রুটি পাওয়া ভবন মালিকদের নোটিস দেয় রাজউক। কিন্তু নোটিস পাওয়ার পর ভবন মালিকরা কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছেন, সে বিষয়ে কোনো তদারকি পরিচালনা করেনি সংস্থাটি।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, সব ভবনের পরিদর্শন কার্যক্রম চলছে। রাজউকের আওতাধীন এলাকার মধ্যে রয়েছে গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জ। সায়েদাবাদের কিছু এলাকা রাজউকের ভেতরে। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ পরিকল্পনা দিয়ে রেখেছে। অনেকে জানতও না। বিভিন্ন এলাকার সরু গলিও এ পরিদর্শন কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। সামগ্রিকভাবে আমরা সর্বত্র ত্রুটি শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেব। কঠোরভাবে এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছি আমরা। কাউকেই এক্ষেত্রে আলাদা কোনো অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ নেই।

অভিযোগ আছে, যথাযথ প্রক্রিয়ায় ছাড়পত্র নেয়ার ক্ষেত্রে ইমারত মালিক ও নির্মাতাদের নিরুৎসাহিত করেন রাজউকের একশ্রেণীর কর্মকর্তা। অনেক ক্ষেত্রে ইমারত মালিক ও নির্মাতারাও জানেন না এসব ছাড়পত্র ভুয়া। অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে তারা এসব নকশা অনুমোদন করিয়ে দেন। অনেক আবাসন প্রতিষ্ঠান আবার অনুমোদনের অতিরিক্ত উচ্চতার ভবনও তৈরি করে। এসব অভিযোগে রাজউকের বেশকিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

নিয়মকানুন না মেনে গড়ে ওঠা রাজধানীর কতটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান সরকারের কোনো সংস্থার কাছেই নেই। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় অঞ্চলভিত্তিক সমীক্ষা করে প্রায় ৭০ হাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিল্ডিং কোড যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তবে রাজধানীতে বহুতল ভবনের ৯০ শতাংশ ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে। এজন্য ভবন নির্মাণ বিধিমালা প্রয়োগ খুবই জরুরি। যে ভবনগুলো আছে সেগুলোর ঝুঁকি নিরূপণ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া না হলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান এ প্রসঙ্গে বলেন, রাজউকের প্রধান কাজ রাজধানীতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প তদারকি করা। কিন্তু সেটি না করে তারা নিজেরাই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প করতে আগ্রহী। গত বছর রাজউকেরই করা এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল রাজধানীতে ৭০-৭৮ ভাগ ভবন ত্রুটিপূর্ণভাবে গড়ে উঠেছে। সে প্রতিবেদনে তারা তাদের গাফিলতির কথা স্বীকারও করে নিয়েছিল। এক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতার চেয়ে আন্তরিকতার ঘাটতি প্রকট হয়ে 

উঠেছে। গত কয়েক বছরে তাদের জনবলও বেড়েছে। অথচ সংস্থাটির আন্তরিকভাবে কাজ না করার কারণে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প রাজধানীবাসীর জন্য নতুন ভোগান্তি সৃষ্টি করছে।

২০০৮ সালের ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ নির্মাণকাজ শেষ করার পর তা ব্যবহার বা বসবাসের জন্য সনদ নিতে হবে। এ সনদ পাওয়ার আগে ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না। ব্যবহার বা বসবাস-সনদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। এ সময়ের পর এটি বাধ্যতামূলকভাবে নবায়ন করতে হবে। এরই মধ্যে আইন চালুর ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। এই ১০ বছরে ৪০ হাজারের বেশি ভবন নির্মাণ হয়েছে রাজধানীতে। অথচ রাজউক থেকে এ ধরনের সনদ নেয়া ভবন নির্মাতার সংখ্যা খুবই কম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনুমোদনের বাইরে গিয়ে বহুতল ভবন নির্মাণের ফলে নকশার সঙ্গে গড়ে ওঠা এসব ভবনের মিল নেই। আবার অনেক ভবনের পরিপূর্ণ নকশাও নেই। এসব ভবনে আগুন লাগলে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকে। তখন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের নকশা না দেখেই অন্ধকারে উদ্ধারকাজ চালাতে হয়। এ কারণে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ে। নির্মাণ শেষে ব্যবহার সনদ না নেয়া হলেও এসব ভবন মালিকের বিরুদ্ধে এ-যাবৎ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।