আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে অর্থনীতিতে তৈরি হচ্ছে প্রাণচাঞ্চল্য

চলতি অর্থবছরের প্রায় সাত মাস পার হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। রাজস্ব আদায় পরিস্থিতির এখনও উন্নতি না হওয়ায় ঘাটতি বেড়েই চলেছে।অর্থবছরের নিয়মিত কর আদায়ের স্বাভাবিক যে লক্ষ্যমাত্রা সেটি করোনা মহামারির কারণে অর্জিত হবে কি-না তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান হলেও এর মধ্যেই অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করার রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ইতোমধ্যে সরকারের রাজস্ব ভাণ্ডারে যোগ হয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার উপরে।

করোনার প্রথম ঢেউ এর সময় অর্থনীতি বিপর্যস্ত ছিল। সরকারের আয় না থাকলেও অর্থনীতি পুনর্গঠন করার একটা চাপ ছিল। বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতি নিয়ে সারা বিশ্বের বিস্ময় আছে। কিন্তু করোনাকালের সংকটে দেশটি কিভাবে তার অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা সচল রাখে, সেটা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। এছাড়া বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়িয়ে অর্থনৈতির চাকা সচল রাখাই ছিল সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

বাজেট পেশ এর আগে করোনা মহামারির সময়ে বিভিন্ন মহল থেকে তাই জোর আলোচনা ছিল অর্থনীতিতে থাকা অপ্রদর্শিত আয়কে বিনা প্রশ্নে বৈধতা দেওয়ার। যাতে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থের প্রবাহ বাড়ানো এবং সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায় ও বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সূদর প্রসারী সিদ্ধান্তে এবং অর্থমন্ত্রীর জোরালো পদক্ষেপে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ায় অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড -এনবিআর এর হিসেবে মতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত আয় অর্থনীতির মূল স্রোতে প্রবেশ করেছে। যার মাধ্যমে সরকার প্রায় হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করেছেন এই সংকট সময়ে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। কারণ পুরো অর্থবছরেও কখনো এত বিপুল পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করার উদাহরণ নেই। সরকারের এই সিদ্ধান্ত কতটা সময়উপযোগী এবং বাস্তবসম্মত ছিল তা সহজেই অনুমেয়।

সরকার শুধু হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে এটাই বড় বিষয় নয়, ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা অপ্রদর্শিত আয় অর্থনীতির মূল স্রোতে প্রবেশ করায় পরবর্তীতে এই সম্পদ থেকে আয় আসলে সেখান থেকে সরকার কর পাবে। এছাড়া আবার করের ওপর সারচার্জও দিতে হবে সেখান থেকেও একটা রাজস্ব আদায় হবে। এই অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন পণ্য তৈরি হবে, নতুন কর্মসংস্থান হবে এবং চক্রাকার একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে একটা ইতিবাচক কর প্রভাব তৈরি করবে। যা অর্থনীতির জন্য ভালো দিক।

প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমান টাকা পাচার হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার হিসেব মতে। পরিমানটা এতো বেশি যা শুনলে শরীর শিউরে উঠে। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টিগ্রিটি বা জিএফআইয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, ২০১৫ সাল পর্যন্ত আগের ১১ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। শুধু ২০১৫ সালেই পাচার হয়েছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের পর তথ্য না থাকলেও বিভিন্ন সংস্থা এবং গণমাধ্যমের মতে, গড়ে বছরে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়।

কর দেওয়ায় পিছিয়ে থাকলেও মুদ্রা পাচার আর কালো টাকার পাহাড় গড়ায় এগিয়ে বাংলাদেশের কতিপয় বিত্তশালী। কর্মসংস্থাননির্ভর বিনিয়োগে পিছিয়ে থাকলেও তাঁদের অনেকেই অবৈধ আয়ের বিপুল টাকা বিদেশে পাচার করে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। অনেকে বিপুল অঙ্কের টাকা আয় করেন, অথচ কর দেন না। নানা উপায়ে ফাঁকি দেন। আয় গোপন করেন। বেনামে টাকা রাখেন। ব্যাংকের ভল্টে সোনাদানা বা ভিন্ন উপায়ে মজুদ রাখেন। পরে সুযোগ বুঝে টাকা পাচার করেন। আমরা চেয়েছিলাম দেশের টাকা দেশে থাকুক, বেগম পাড়া, সেকেন্ড হোমে বিনিয়োগ না হয়ে দেশে বিনিয়োগ হোক। এই বছরে তার কিছুটা বাস্থবায়ন হচ্ছে। এই অর্থ বিনিয়োগে অর্থনীতিতে তৈরি হচ্ছে প্রাণচাঞ্চল্য।

আমরা অনেক দিন ধরে দাবি জানাচ্ছিলাম নীতিগত সহায়তার মাধ্যমে এই টাকা পাচার বন্ধ করা হোক এবং অপ্রদর্শিত আয় তৈরির রাস্তাগুলো বন্ধ হোক। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি অপ্রদর্শিত আয় তৈরির রাস্তাগুলো বন্ধ করার জন্য অধিক পরিমানে অটোমেশন দরকার। সরকার সুয়োগ দেওয়াতে ইতোমধ্যে অনেকেই টাকা বিনিয়োগ করেছে দেশের ভেতর। আগামী বাকি সময়ে হয়তো আরো বড় অংকের বিনিয়োগ হবে এমন প্রত্যাশা আমাদের।

অপ্রদর্শিত অর্থ সমাজে যেমন বৈষম্য তৈরি করে তেমনি আয়কর নথীতে উল্লেখ না থাকায় সরকারও রাজস্ব আয় করতে পারেনা। কাজেই অপ্রদর্শিত অর্থ অর্থনীতির মূল্য স্রোতে ফিরিয়ে আনার অন্য কোন বিকল্প নেই। অনেকেই ঢালাও ভাবে অপ্রদর্শিত আয়কে বিনা প্রশ্নে বিনিয়োগের বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময় সমালোচনায় মেতে উঠেন। সমালোচনাকারীরা এই সুযোগ দেওয়ার বিপক্ষে। তাদের সমালোচনা মূলত পরোক্ষভাবে দেশের বাহিরে টাকা পাচারকারীর পক্ষেই চলে যায়।

অর্থনীতি যাতে বসে না যায়, বিনিয়োগ যেন থমকে না যায়, তার জন্য দরকার টাকা। অর্থনীতিতে টাকা লাগবে। বিনিয়োগ লাগবে। অর্থনীতিতে টাকা ঢোকাতে হবে। অনেকেই বলেন, পাচার রোধ করা গেলে এবং অর্থনীতিতে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ করে দিলে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে অর্থনীতি। এ বছর সেই সুযোগ থাকায় সংকটের মধ্যেও অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ।