কালো টাকা সাদা করার সুযোগ এবং ব্যাংকের আমানতের ওপর সুদ হার কমানোয় করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যেও ২০২০ সালে বেশ জমজমাট ছিল আবাসন খাত। গত বছরের মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরু হলেও জুন পর্যন্ত বেশ রয়ে-সয়ে চলেছে এ খাত।
তবে সংক্রমণ কমে এলে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ক্রেতারা ফ্ল্যাটের খোঁজখবর নিতে শুরু করেন। অক্টোবরের শেষ দিক থেকে বাড়তে থাকে ফ্ল্যাট কেনাবেচা। নভেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে প্রায় দুই হাজার ফ্ল্যাট কেনাবেচা হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেও এ ধারা অব্যাহত ছিল। মার্চে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ হার ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করলে স্থবিরতা আসে দেশের আবাসন খাতে।
ক্ষতি পোষাতে নতুন বাজেটে রেজিস্ট্রেশন কস্ট কমানোসহ কালো টাকা বিনা প্রশ্নে সাদা করে আবাসন খাতে ব্যবহারের যে সুযোগ রয়েছে, তা অব্যাহত রাখার দাবি
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক-দেড় মাসে কোনো ফ্ল্যাটই বিক্রি হয়নি। এমনকি কিস্তির টাকা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেক ক্রেতা। তবে বেঁধে দেয়া সময়ের (ডেডলাইন) মধ্যে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়ার জন্য একদিনের জন্যও নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা হয়নি। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে রড-সিমেন্টের মূল্যবৃদ্ধি।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে। যেহেতু অফিস বন্ধ রেখেছিলাম, ফলে এ সময়ে ফ্ল্যাট বেচাকেনা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘সবকিছু বন্ধ থাকায় ক্ষতি তো হচ্ছেই। নতুন করে ফ্ল্যাট বিক্রি নেই। এখানে হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। সেটার ওপর ভ্যাট, ট্যাক্সের ব্যাপার তো আছেই। বিক্রয় মূল্যের চেয়ে খরচ বেড়ে যায় অনেক সময়। এখন যতদিন যাচ্ছে, ততোই আমাদের ব্যয় বাড়ছে। ফলে স্বাভাবিক কারণে বড় ধরনের ক্ষতি হবে ডেভেলপারদের।’ ক্ষতি পোষাতে নতুন বাজেটে রেজিস্ট্রেশন কস্ট কমানোসহ কালো টাকা বিনা প্রশ্নে সাদা করে আবাসন খাতে ব্যবহারের যে সুযোগ রয়েছে, তা অব্যাহত রাখার দাবি জানান তিনি।
ব্রিক ওয়ার্কস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী ভূঁইয়া মিলন জাগো নিউজকে বলেন, ‘লকডাউনের জন্য আবাসন খাতে মন্দা চলছে। গত বাজেটে আমাদের কিছু সুযোগ দেয়া হয়েছিল। আমাদের বেচাকেনা ভালোই চলছিল। মোটামুটি সবারই ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। তবে লকডাউনের কারণে এখন বেচাকেনা পুরোপুরি বন্ধ। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। দু-তিন মাস পর সেটা হাড়ে হাড়ে সবাই বুঝতে পারবে।’
এ সময়ে নতুন বিক্রি না থাকা এবং ক্রেতাদের কিস্তি পরিশোধে গড়িমসির চেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে রড, সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি
কিস্তি পরিশোধে ক্রেতাদের হিমশিম
হার্ব হোল্ডিং লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. আহকাম উল্লাহ ইমাম খান জাগো নিউজকে বলেন, যাদের টাকা আছে, তারা এখন কেউ আর বের করতে চাচ্ছেন না। করোনার মধ্যে ফ্ল্যাট কেনার প্রশ্নই ওঠে না। ক্রেতারা ইনস্টলমেন্টও পরিশোধ করছেন না। তারা বলেন, করোনার মধ্যে কীভাবে দেব? কিন্তু আমাদের নির্মাণকাজ তো আর থেমে নেই।’
তিনি বলেন, ‘লকডাউনের মধ্যে সবকিছু বন্ধ থাকলেও চালু আছে নির্মাণকাজ। ক্রেতাদের ডেডলাইনের মধ্যে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে ও ঠিকাদার-শ্রমিকের সঙ্গে কমিটমেন্টের কারণে আমরা কাজ বন্ধ রাখতে পারিনি। কাজ বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকরা পরিবার নিয়ে কষ্টে পড়বে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই নির্মাণকাজ চলছে।’
সরকারি প্রণোদনা প্রসঙ্গে এই আবাসন ব্যবসায়ী বলেন, ‘সরকারের আর্থিক প্রণোদনা পেতে বা সরকারি সহায়তা নিতে যেসব শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে, তা মেনে আবাসন ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না।’
বেঙ্গল ওয়ান ক্রিয়েশনের সিইও ইঞ্জিনিয়ার মো. সোহেল রানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনার প্রকোপ কমার অপেক্ষা করছি। এটা ছাড়া আর করার কিছুই নেই। মানুষ বের হতে পারছে না। ফ্ল্যাট তো অনলাইনে কেনা সম্ভব নয়। ক্রেতা আসবে, দেখবে তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন। বাসায় বসে তো ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব নয়। এ সময় আবাসন খাতের অনুকূলে না।’
তিনি বলেন, ‘গত বছর করোনার পরেই আমরা ভালো কামব্যাক করেছি। প্রচুর ফ্ল্যাট বিক্রিও করেছি। তবে এখন আবার একটু পিছিয়ে গেলাম। এটা আসলে মেনে নিতে হবে। সামনে আরও সুযোগ আসবে। সুদিনের আশায় থাকা ছাড়া কিছু করার নেই।’
দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি
করোনা সংক্রমণে ফ্ল্যাট কেনাবেচা বন্ধ থাকলেও নির্মাণকাজ চালু রেখেছেন প্রায় সব ডেভেলপার। শ্রমিকদের রুটি-রুজি এবং ক্রেতাকে ডেডলাইনের মধ্যে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে কাজ চালু রাখা ছাড়া উপায় নেই। তবে এ সময়ে নতুন বিক্রি না থাকা এবং ক্রেতাদের কিস্তি পরিশোধে গড়িমসির চেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে রড, সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি।
বাজার ঘুরে জানা গেছে, গত কয়েক মাসে নির্মাণসামগ্রীর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে এবং ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে। কোম্পানি ভেদে ৬০ গ্রেডের রড বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ৬৬-৬৮ হাজার টাকা। ৪০ গ্রেডের রড বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ৫৫-৫৮ হাজার টাকা। বি ৫০০ ডব্লিউ কোম্পানিভেদে প্রতি টন বিক্রি হচ্ছে ৭৩-৭৮ হাজার টাকায়।
৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ৪৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৫৮০ টাকায় ঠেকেছে। দুই মাস আগে প্রতি বস্তা সিমেন্ট ৩৭০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে ছিল। বস্তাপ্রতি সিমেন্টে দাম বেড়েছে ১০০ টাকারও বেশি। এভাবে প্রতিটি নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত।
এ প্রসঙ্গে রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে আমাদের ব্যবসায়। দাম বাড়ায় আমাদের খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রভাব রয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আমাদের মিটিং করার কথাও ছিল, কিন্তু করোনার কারণে সেই মিটিং করা সম্ভব হয়নি।
ব্রিক ওয়ার্কস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী ভূঁইয়া মিলন বলেন, ‘রডের দামসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ছে। এটা সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। নির্মাণ খরচ বাড়লে ফ্ল্যাট ক্রেতার ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাবে। তখন এ খাতের সঙ্গে জড়িত সবাইকে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।’ জাগোনিউজ২৪