আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
বাড়িভাড়ার ওপর গৃহকর আদায় অযৌক্তিক

১৯৮৬ সালের ‘দ্য সিটি করপোরেশন ট্যাক্সেশন রুলস’ অধ্যাদেশটি জারি করা হয়েছিল দেশের তদানীন্তন চারটি সিটি করপোরেশন—ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীর জন্য। অধ্যাদেশ জারির ৩৫ বছর পার হয়ে গেলেও দেশের রাজধানী ঢাকাসহ কোনো নগরেই ওই অধ্যাদেশে নির্দেশিত বাড়িভাড়ার আয়ের ভিত্তিতে গৃহকর নির্ধারণের ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করা যায়নি। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের মেয়াদকালে কোনো মন্ত্রী বা আমলার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে হয়তো বাড়িভাড়ার ভিত্তিতে হোল্ডিং ট্যাক্স বা গৃহকর নির্ধারণের এই ভুল অধ্যাদেশের ধারণার জন্ম হয়েছিল, যা বিশ্বের আর কোথাও চালু নেই। কারণ, বাড়িভাড়া হলো বাড়ির মালিকের আয়, যার ভিত্তিতে তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে নিয়মমাফিক প্রতিবছর আয়কর পরিশোধ করতে বাধ্য। ওই একই বাড়িভাড়ার আয়ের ভিত্তিতে যদি তাঁকে আবার গৃহকর দিতে হয়, তাহলে তো আয়ের ওপর ‘ডাবল ট্যাক্সেশন’ হয়ে যাবে, যা সর্বস্বীকৃত করনীতির পরিপন্থী বিধায় বিশ্বের সব দেশেই নিষিদ্ধ।

সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাড়িভাড়ার জরিপ চালাতে গিয়ে অসংখ্য জোরজবরদস্তির ঘটনা ঘটিয়েছেন, ঘুষ-বাণিজ্যের মাধ্যমে মনগড়া ভ্যালুয়েশন নির্ধারণ করেছেন, কাউকে অন্যায় সুবিধা দিয়েছেন, কাউকে আবার গলাকাটা ভাড়া দেখিয়ে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এরপর আবার আপিলের নামে আরেক দফা ঘুষ-বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন।

গৃহকরকে ‘ট্যাক্সেশন তত্ত্বে’ সম্পত্তি কর বা প্রোপার্টি ট্যাক্স অভিহিত করা হয়। প্রোপার্টি ট্যাক্স নির্ধারণের বিশ্বস্বীকৃত নিয়ম হলো সম্পত্তির অবস্থানের গুরুত্ব, আয়তনের মাপ, ওই সম্পত্তির গুণগত মান এবং কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যের রকমফের বিবেচনায় নিয়ে করহার কমবেশি ধার্য করা। নগরীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিটি সেন্টারে সম্পত্তি-করহার বেশি হবে, কমার্শিয়াল জোনে করহার বেশি হবে, সিটি সেন্টার থেকে যতই দূরবর্তী এলাকায় বা শহরতলিতে সম্পত্তির অবস্থান হবে, ততই কর ক্রমান্বয়ে কমে আসবে। মাল্টিস্টোরেড হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের অ্যাপার্টমেন্টে যে হারে গৃহকর ধার্য হবে, একতলা টিনের ছাউনি সেমিপাকা বাড়ির গৃহকর তার সঙ্গে তুলনীয় হতেই পারে না। মার্বেল পাথরের মেঝেযুক্ত অ্যাপার্টমেন্টের করহার শুধু সিমেন্টের মেঝেযুক্ত ফ্ল্যাটের করহারের তুলনায় অনেক বেশি হবে। বেড়ার ঘর হলে হয়তো কোনো গৃহকরই ধার্য হবে না।

অধ্যাদেশ জারির ৩০ বছর পর ২০১৬ সালে হঠাৎ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তদানীন্তন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ১৯৮৬ সালের ওই অধ্যাদেশের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের ১১টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে প্রথম বাড়িভাড়ার আয়ের ভিত্তিতে গৃহকর পুনর্মূল্যায়ন শুরু করে দেন। পুনর্মূল্যায়ন শুরু হতেই দেখা গেল, নতুন ধারায় গৃহকরের পরিমাণ একলাফে প্রচলিত করের ৫ থেকে ৬ গুণ, এমনকি ১০ গুণ বেড়ে যাচ্ছিল। অতএব, ওই অযৌক্তিক পদ্ধতির বিরুদ্ধে করদাতাদের প্রতিবাদ দ্রুত প্রতিরোধ আন্দোলনে পরিণত হলো। উপরন্তু, এই ভুল সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নের শুরু থেকেই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাড়িভাড়ার জরিপ চালাতে গিয়ে অসংখ্য জোরজবরদস্তির ঘটনা ঘটিয়েছেন, ঘুষ-বাণিজ্যের মাধ্যমে মনগড়া ভ্যালুয়েশন নির্ধারণ করেছেন, কাউকে অন্যায় সুবিধা দিয়েছেন, কাউকে আবার গলাকাটা ভাড়া দেখিয়ে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এরপর আবার আপিলের নামে আরেক দফা ঘুষ-বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন।

১৯৮৬ সালের ‘দ্য সিটি করপোরেশন ট্যাক্সেশন রুলস’ অনুসরণে বাংলাদেশের ১১টি সিটি করপোরেশনের যেখানেই গৃহকর নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হবে, সেখানেই অতীতের মতো আবার করদাতাদের তোপের মুখে পড়তে হবে কর্তৃপক্ষকে।

পত্রপত্রিকায় যখন ইস্যুটির বিরুদ্ধে জনমত জোরদার হতে শুরু করল, তখন নাছির উদ্দীন মিডিয়ার সামনে চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার বিষোদ্‌গার করতেও পিছপাও হননি। কিন্তু নতুন হারে গৃহকর আদায়ের তোড়জোড় শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই নগরীর করদাতাদের ধূমায়িত ব্যাপক ক্ষোভ উত্তপ্ত বিক্ষোভ ও জনপ্রিয় আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীও তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত আগে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ওই তীব্র আন্দোলনের প্রভাবে নাছির উদ্দীনের জনপ্রিয়তা অতি দ্রুত শূন্যে নেমে গিয়েছিল, যা আর কখনো তিনি পুনরুদ্ধার করতে পারেননি। পাঠকদের হয়তো মনে আছে, নাছির উদ্দীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তদানীন্তন মেয়র সাঈদ খোকন ওই অধ্যাদেশের ভিত্তিতে গৃহকর পুনর্মূল্যায়নের প্রয়াস নেওয়ায় ঢাকায়ও আন্দোলনের জোয়ার জোরদার হতে শুরু করেছিল। ফলে সরকার তড়িঘড়ি করে পুরো ব্যাপার স্থগিত ঘোষণা করেছিল।

দৈনিক আজাদীতে কয়েক দিন ধরে প্রকাশিত সংবাদে মনে হচ্ছিল, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীও এই অযৌক্তিক অধ্যাদেশ বাস্তবায়নের ভুল পথে যাত্রা করেছিলেন। ২৫ জুনের পত্রপত্রিকার খবরে স্বস্তি পেলাম যে তাঁর এ-সংক্রান্ত পদক্ষেপ জানাজানি হওয়ার পর দৈনিক আজাদী চট্টগ্রামের বিভিন্ন পেশার বিশিষ্টজনদের যে ধারাবাহিক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে চলেছিল, তাতে শেষ পর্যন্ত হয়তো তাঁর বোধোদয় ঘটেছে। তিনি ২৪ জুনের সিটি কাউন্সিল সভায় ঘোষণা দিয়েছেন, আপাতত গৃহকর বাড়ানো হবে না। স্বস্তি এ জন্য যে এই ভুল অধ্যাদেশের ভিত্তিতে গৃহকর পুনর্মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁর পূর্বসূরি মেয়র নাছিরকে যে ব্যাপক আন্দোলনের মোকাবিলা করতে হয়েছিল, তা তাঁর জনপ্রিয়তাকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছিল। আমরা চাই না রেজাউল করিম চৌধুরীও একই বিপদের সম্মুখীন হোন। যাঁরা এই পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাঁরা তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী নন।

আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, এ ব্যাপারে কিছু করতে হলে প্রথমে সব সিটি করপোরেশনের গৃহকরের সামঞ্জস্য বিধানকল্পে নতুন আইন প্রণয়ন প্রয়োজন হবে। বাড়িভাড়ার ভিত্তিতে গৃহকর নয়, সম্পত্তির অবস্থান, বর্গফুট, গুণগত মান এবং কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যই হতে হবে গৃহকর নির্ধারণের ভিত্তি। অতএব অবিলম্বে দেশের সব সিটি করপোরেশনের গৃহকর নির্ধারণের পদ্ধতিকে ইউনিফর্ম পদ্ধতিতে নিয়ে আসার জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করে কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক অবিলম্বে সংসদে একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ এখন ফরজ হয়ে গেছে। প্রয়োজনে কমিশন ভারতের মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতা ও চেন্নাইয়ের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের লন্ডন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নগরীতে বিদ্যমান পদ্ধতির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে আইনের খসড়া প্রণয়নই সমীচীন হবে। কারণ, ১৯৮৬ সালের ‘দ্য সিটি করপোরেশন ট্যাক্সেশন রুলস’ অনুসরণে বাংলাদেশের ১১টি সিটি করপোরেশনের যেখানেই গৃহকর নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হবে, সেখানেই অতীতের মতো আবার করদাতাদের তোপের মুখে পড়তে হবে কর্তৃপক্ষকে।

বাংলাদেশের ১১টি সিটি করপোরেশনের গৃহকর নির্ধারণ ও আদায়ের পদ্ধতিগুলোয় কোনো রকম সামঞ্জস্য বিধান করা হয়নি এবং এ ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে চরম নৈরাজ্য বিরাজ করছে।

পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই, ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর প্রথম আলো পত্রিকার লিড নিউজ হিসেবে যে চাঞ্চল্যকর খবরটা প্রকাশিত হয়েছিল, তা হলো দেশের ১১টি সিটি করপোরেশনে মোট ছয় ধরনের গৃহকরের হার বলবৎ রয়েছে, যেখানে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বার্ষিক সর্বনিম্ন ১২ শতাংশ, গাজীপুর সিটি করপোরেশনেও ১২ শতাংশ, খুলনা সিটি করপোরেশনে ১৬ শতাংশ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ১৭ শতাংশ, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে ১৭ শতাংশ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে ১৯ শতাংশ, সিলেট সিটি করপোরেশনে ২০ শতাংশ, রংপুর সিটি করপোরেশনে ২০ শতাংশ এবং রাজশাহী ও বরিশাল সিটি করপোরেশনে ২৭ শতাংশ হারে গৃহকর আদায় করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু এই ছয় রকমের গৃহকরের হারের ফলে রাজশাহী ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের করদাতারা অন্য নয়টি নগরীর করদাতাদের চেয়ে বেশি পরিমাণ গৃহকর দিচ্ছেন বলে ধারণা করলে সঠিক হবে না।বিজ্ঞাপন

এমনকি চট্টগ্রামের করদাতারা ঢাকার করদাতাদের চেয়ে বেশি গৃহকর দিচ্ছেন কি না, তা-ও সঠিকভাবে বলা যাবে না। কারণ, এই ১১টি সিটি করপোরেশনে বাড়ির ভ্যালুয়েশনে কোনো ইউনিফর্ম পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। ফলে রাজশাহী বা বরিশালে বাড়ির ভ্যালুয়েশন কম হলে ওই ভ্যালুয়েশনের ২৭ শতাংশ গৃহকরের পরিমাণ ঢাকা বা চট্টগ্রামের চেয়ে কম হতে পারে। তবে এটুকু বলা যেতে পারে যে বাংলাদেশের ১১টি সিটি করপোরেশনের গৃহকর নির্ধারণ ও আদায়ের পদ্ধতিগুলোয় কোনো রকম সামঞ্জস্য বিধান করা হয়নি এবং এ ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে চরম নৈরাজ্য বিরাজ করছে। আরও তাৎপর্যপূর্ণ হলো, এই ১১ সিটি করপোরেশনের কোনোটিতেই গৃহকরের হার নির্ধারণের ভিত্তি হিসেবে বাড়িভাড়ার আয়কে ব্যবহার করা হয় না।

এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকে ১৯৮৬ সালের ‘দ্য সিটি করপোরেশন ট্যাক্সেশন রুলস’ সংশোধনের জন্য একটি শক্তিশালী কমিশন গঠনের অনুরোধ জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে ১৯৮৬ সালের অধ্যাদেশটি বাতিলের জন্য আবেদন করছি। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের খামখেয়ালির ফসল একটি মারাত্মক ভুল অধ্যাদেশের ভিত্তিতে সিটি করপোরেশনগুলোর অযৌক্তিক গৃহকর আদায়ের জবরদস্তি সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।

মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

প্রথম আলো