আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
ঝুঁকির আশঙ্কায় গৃহায়নের নির্মাণাধীন ভবন

মিরপুরে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পে থরে থরে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নেই প্রত্যাশিত তদারকি। ভবন নির্মাণে মানা হয়নি বিল্ডিং কোড। এ কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে একাধিক ভবনে। নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ও মান্ধাতা পদ্ধতিতে চলছে ভবন নির্মাণের কাজ। দুই দফা বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হলেও ওই সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। সাড়ে চার বছরে প্রকল্পের মাত্র ৫৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ভবন নির্মাণসহ এ প্রকল্পে ৪৭ ধরনের পূর্ত কাজ থাকলেও ৩৮ ধরনের কাজের অগ্রগতি জিরো পারসেন্ট।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সাম্প্রতিক নিবিড় পরিবীক্ষণে এ চিত্র পাওয়া গেছে। আইএমইডি নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই পরিবীক্ষণ করোনা হয়।

পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে প্রতিশ্রুত সময়ে ফ্ল্যাট বুঝে না পেয়ে গ্রাহকদের বিক্ষুব্ধ হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ানোর আশঙ্কার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

পরিকল্পিত উপায়ে অল্প জমির ওপরে সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধার অত্যাধুনিক আবাসিক ভবন নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরীতে তীব্র আবাসন সমস্যা সমাধানে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ‘ঢাকার মিরপুর ৯ নম্বর সেকশনে ১৫টি ১৪ তলাবিশিষ্ট আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ (২য় পর্যায়) প্রকল্প’ গ্রহণ করে। গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে ৯৩৬ কোটি ৩ লাখ ১৭ হাজার টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়ে ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল।

‘স্বপ্ননগর দ্বিতীয় পর্ব’ নামের এ প্রকল্পে ১ হাজার ৫৬০টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করার কথা রয়েছে। ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। করোনার কারণ দেখিয়ে এক বছর পর প্রকল্পটির মেয়াদ আরও  ছয় মাস বাড়িয়ে  ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়।

অবশ্য নিচু এলাকায় অবস্থিত প্রকল্প এলাকার জমি ভরাট ও সেখানকার অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের কাজ শুরু করতে প্রথমেই ছয় মাসের মতো দেরি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া কোভিড-১৯-এর কারণে ছয় মাস কাজ বন্ধ ছিল বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রকল্পের আওতায় ১৫টি ১৪ তলা ভবনের কোনোটিরই কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। চলতি বছরের মে পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি গড়ে ৫৫% এবং আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৪২.০৯%। প্রতিবেদনে কাজের এ অগ্রগতি সন্তোষজনক নয় বলে মন্তব্য করা হয়েছে।

প্রকল্পে বছরভিত্তিক কর্মপরিকল্পনার কথা থাকলেও তা হয়নি। কেনাকাটায় ক্রয় পরিকল্পনা তৈরি করা হয়নি। পাবলিক প্রকিউরমেন্টের নির্দেশনারও ব্যত্যয় ঘটেছে। কেনাকাটার ২০টি প্যাকেজের মধ্যে ৯টি কোনও ধরনের দরপত্র ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছে।

নির্মাণসামগ্রী বুয়েট থেকে ‘সন্তোষজনক’ ল্যাব টেস্ট করানো হলেও ৫টি ভবনে নিম্নমানের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। ভবনের রডের গ্রেড যথাযথ হলেও সেগুলো দেশের প্রতিষ্ঠিত ও শীর্ষস্থানীয় কোম্পানির তৈরি নয়। ভবনের ফলস স্ল্যাব ও লিন্টেলের ঢালাইয়ে ময়লা-আবর্জনাযুক্ত নিম্নমানের পাথর ব্যবহার করা হচ্ছে।

ভবনগুলো অনুমোদিত ড্রইং ও ডিজাইন অনুযায়ী হচ্ছে। তবে ওজন ও পরিমাপ মানদণ্ডে দেশের আইনের নির্দেশনা অমান্য করা হয়েছে। সিঁড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও ব্যত্যয় হয়েছে। এছাড়াও বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে যেসব আধুনিক পদ্ধতি ও সরঞ্জামাদি ব্যবহৃত হয়ে থাকে, সেটাও পুরোপুরি অনুসরণ করা হচ্ছে না।

ঢালাইয়ের পর সঠিকভাবে কিউরিং করা হচ্ছে না। এ  কারণে অন্তত তিনটি ভবনের বেশ কয়েকটি ছাদের অনেক জায়গায় এক মিলিমিটারের চেয়ে বেশি ফাটল দেখা গেছে।

কয়েকটি ভবনে শেয়ারওয়ালের অ্যালাইনমেন্ট যথাযথ হয়নি। অ্যালাইনমেন্ট কোথাও কোথাও ১/২ সেন্টিমিটার পার্থক্য দেখা গেছে। শেয়ারওয়ালের কোথাও কোথাও ঢালাইয়ের রড বেরিয়ে পড়েছে।

ডিপিপি অনুযায়ী, পিলার মজবুত ও টেকসই করতে প্রতিটি পিলারের (খুঁটি) রড ভিন্ন মাপের দেয়ার কথা থাকলেও কয়েকটি ভবনে একই মাপের রড দেওয়া হয়েছে। এ কারণে পিলারের একই জায়গায় সব রডে জোড়ার প্রয়োজন পড়ছে। প্রতিবেদনে বিষয়টিকে ভবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মন্তব্য করা হয়েছে।

অধিকাংশ বিমে ঢালাইয়ের পর হানিকম্ব দেখা দিয়েছে। প্রকল্পের কর্মপরিবেশ ও শ্রমিকদের নিরাপত্তায় কোনও সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই।

প্রতিবেদনে আরও  বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় ফ্ল্যাটের ক্রেতাদের  মধ্যে ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে। এছাড়া এজন্য স্বল্প ও মধ্যম আয়ের জনগণ সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে। ৪৭টি পূর্ত কাজের মধ্যে ৩৮টি এখনও শুরু হয়নি। অথচ ডিপিপি অনুযায়ী, এর প্রায় সব কাজ সম্পন্ন হওয়ার বেঁধে দেওয়া সময় ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, আবাসিক ভবন নির্মাণের কাজ ৫৪ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ভবন শেষ না হওয়ার কারণে প্লাম্বিং, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।

প্রতিবেদনের ফাইন্ডিংসে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত ভূমি উন্নয়নের কাজ সম্পন্ন হয়নি। ১৫টি ভবনের মধ্যে একটিরও কাজও শেষ হয়নি। পাঁচটি ভবন নির্মাণের কার্যাদেশ পাওয়া একক  ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজের দিক থেকে অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। একটি ভবনের ঠিকাদার কাজ ফেলে চলে যাওয়ার কারণে সেটির কাজ শেষ করতে নতুন করে দরপত্রের প্রয়োজন পড়বে।

রাস্তার উন্নয়ন, বৈদ্যুতিক অবকাঠামো, গভীর নলকূপ স্থাপন ও সীমানা প্রাচীরসহ বেশ কিছু কাজ শুরু হয়নি। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেদনে ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের আউটপুট অর্জন খুবই কম বলে উল্লেখ করা হয়।

প্রকল্পটি ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়াও  প্রকল্পের আওতায় ৩৪৩টি ফ্ল্যাট বরাদ্দ হয়নি বলে উল্লেখ করা হয় (অবশ্য গত ৩০ জুন বরাদ্দ হয়েছে)। ফ্ল্যাট বরাদ্দপ্রাপ্তরা যথাসময়ে ফ্ল্যাট বুঝে না পাওয়ায় গ্রাহকরা মাসে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। পাশাপাশি তারা মানসিক ও সামাজিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্মাণকাজের ধীরগতি, ভবিষ্যতে ফ্ল্যাটের মূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে বরাদ্দপ্রাপ্তরা যথাসময়ে ফ্ল্যাটের বাস্তব দখল বুঝে না পেলে বিষয়টি আদালতে গড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। আর সেটা হলে নির্মাণকাজে বিঘ্ন এবং অবরাদ্দকৃত ফ্ল্যাটগুলোর বরাদ্দও হুমকির  মুখে পড়তে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমইডি’র সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকটি চলমান প্রকল্প নিবিড় পরিবীক্ষণ করিয়েছি। এই প্রকল্পটিও তার মধ্যে রয়েছে। আমরা তাদের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। কাজের গতি ও তদারকি বাড়াতে বলেছি। এ বিষয়ে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ বিস্তারিত বলতে পারবেন।’

‘স্বপ্ননগর দ্বিতীয় পর্ব আবাসন প্রকল্পের’ পরিচালক ড. মইনুল হক আনছারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটি আমাদের নিজস্ব প্রকল্প। আইএমইডি চাইলে সরকারের যেকোনও প্রকল্প পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে পারে। সেই হিসেবে তারা এটা করেছে। আমরা তাদের পরিবীক্ষণকে স্বাগত জানিয়েছি। তাদের সব ধরনের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছি। তাদের ফাইন্ডিংসগুলোকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। তাদের এ পরিবীক্ষণ আমাদের কাজকে আরও গতিশীল ও সুন্দর করবে। তাছাড়া এখানকার শিক্ষা সরকারের ভবিষ্যৎ প্রকল্পের জন্য সহায়ক হবে।’

বেঁধে দেওয়া সময় অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এর কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘আমরা সময় বাড়ানোর আবেদন করবো।’ বাংলাট্রিবিউন