নগরের প্রতিটি আবাসিক এলাকার ভবন হবে একই উচ্চতার। প্রতি ওয়ার্ডে থাকবে স্কুল, কলেজ ও কমিউনিটি ক্লিনিক। থাকবে খেলার মাঠ এবং মুক্ত জায়গা। কৃষিজমি, জলাশয়, বনাঞ্চল থাকবে উন্মুক্ত। যানজট কমাতে শহরের চারপাশে রিং রোডের পাশাপাশি খাল-নদীতে থাকবে নৌপথ, চলবে ওয়াটার বাস। পথচারীদের জন্য চওড়া ফুটপাত আর পৃথক অঞ্চলে হবে বাণিজ্যিক কল-কারখানা। আর তাতে দূষণ থেকে মুক্তি মিলবে নগরীর প্রাণ-প্রকৃতির।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের জন্য স্বপ্নের মতো এমন ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই বহুল প্রত্যাশিত এ ড্যাপ গেজেট প্রকাশ হবে। এরইমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে সংস্থাটি। আগের ড্যাপে কৃষিজমি কিংবা জলাশয় সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ ছিল না। এবার টিডিআর পলিসির (ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইটস) প্রস্তাব করেছি। এছাড়া ঢাকার ভেতরে ৫৬৬ কিলোমিটার নদীপথ নতুন করে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা প্রস্তাবের পাশাপাশি সিএস এবং আরএস রেকর্ড অনুযায়ী খালগুলোকে পুনরুদ্ধার করে ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করার কৌশলও আছে নতুন ড্যাপে।
রাজউক সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ড্যাপ চূড়ান্তের মাধ্যমে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরকে আধুনিক, দৃষ্টিনন্দন ও বসবাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলা হবে। তবে ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশের প্রস্তুতি খুব সহজ ছিল না। ২০ বছর মেয়াদি এ উদ্যোগের অনুমোদন পেতেই কেটেছে পাঁচ বছর। পদে পদে ছিল নানা প্রতিবন্ধকতা। এখন সব ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করে প্রকাশের অপেক্ষায় ড্যাপ গেজেট।
নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে বহু মহাপরিকল্পনা হয়েছে। কিন্তু এর কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। এখন প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা ড্যাপ গেজেট যথাসময়ে বাস্তবায়ন হলে উপকৃত হবেন নগরবাসী। অন্যথায় জনসংখ্যার ধারণ ক্ষমতা হারাবে ঢাকা। বিপর্যয়ে পড়বে প্রাণ-পরিবেশ-প্রকৃতি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও ড্যাপ রিভিউ মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক তাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আগামী নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে জাতীয় সেমিনার হবে। এরপর ড্যাপ রিভিউয়ের জন্য গঠিত মন্ত্রিসভা কমিটির মাধ্যমে চূড়ান্ত করে হবে গেজেট প্রকাশ। এরপর গেজেট বাস্তবায়নের সময় কোথাও কোনো ভুল-ভ্রান্তি বা অসামঞ্জস্য থাকলে কিংবা কোনো যৌক্তিক কারণে পরিবর্তন অথবা সংশোধনের দরকার হলে তা অবশ্যই করা হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ডিসেম্বরের মধ্যেই গেজেট চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে।
ড্যাপে পুরান ঢাকার বিভিন্ন সাইট চিহ্নিত করে ‘আরবান রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্প’ নেওয়ার প্রস্তাব হয়েছে। এর মাধ্যমে এলাকাবাসীর মতামত নিয়ে অল্প জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের মাধ্যমে পুরান ঢাকায় পরিকল্পিত নগরায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
রাজউক সূত্র জানায়, ঢাকাকে বসবাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রথমে (১৯৯৫-২০১৫) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) নেওয়া হয়েছিল। ২০১০ সালের জুনে ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ হলেও তাতে নানা অসঙ্গতি দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে এটি ছিল বাস্তবতা বিবর্জিত। পরে ড্যাপ পর্যালোচনার জন্য সাত জন মন্ত্রীকে নিয়ে একটি ‘মন্ত্রিসভা কমিটি’ গঠন করে সরকার। এ কমিটিকে ড্যাপ রিভিউ কমিটিও বলা হয়। পরবর্তীতে আবারও ড্যাপ সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। ফলে বাস্তবে রূপ পায়নি ওই পরিকল্পনা।
জানা যায়, ২০১৫ সালের মার্চে এ প্রকল্পের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান শেলটেক (প্রা:) লিমিটেড ও ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালটেন্টস লিমিটেডকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আগের ড্যাপের ত্রুটি বিচ্যুতি সংশোধন এবং স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে একটি জনবান্ধব, বাস্তবসম্মত ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ), ২০১৬-২০৩৫ প্রণয়নই রাজউকের চলমান ড্যাপ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। এখন ড্যাপ (২০১৬-২০৩৫) প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
রাজউকের ওয়েবসাইটে ড্যাপের পরিকল্পনা নিয়ে বলা হয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপদ আবাসস্থলের জন্য আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প এলাকা, বিনোদন পার্ক, খেলার মাঠ, লেক, সাংস্কৃতিক বলয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, কমিউনিটি সেন্টারসহ সামাজিক চাহিদার জন্য প্রয়োজনীয় স্থানসমূহ চিহ্নিত হচ্ছে এ ড্যাপে। এতে বিভিন্ন এলাকার নিজ বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ঢাকা শহরের জনসংখ্যার চাপ কমাতে ড্যাপে জনঘনত্ব জোনিং বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব নির্ধারণ ও সে মোতাবেক ভূমি ব্যবহার এবং প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধা সংস্থানের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে।
ড্যাপ রিভিউ মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক তাজুল ইসলাম বলেন, ড্যাপে পুরান ঢাকার বিভিন্ন সাইট চিহ্নিত করে ‘আরবান রিডেভেলপমেন্ট প্রকল্প’ নেওয়ার প্রস্তাব হয়েছে। এর মাধ্যমে এলাকাবাসীর মতামত নিয়ে অল্প জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের মাধ্যমে পুরান ঢাকায় পরিকল্পিত নগরায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
গত ২৪ অক্টোবর সচিবালয়ে ড্যাপ চূড়ান্ত করা নিয়ে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। ওই সভায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম, দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, গাজীপুর সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, নগর বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের যুক্তিসঙ্গত মতামতের ভিত্তিতে ড্যাপ তৈরি হয়েছে। এবার আমরা ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করছি। এতে মানুষ নিজের ও আশপাশের ভূমির ব্যবহার এবং পরিকল্পনা সম্পর্কে মুহূর্তেই জানতে পারবেন।
তিনি বলেন, আগের ড্যাপে কৃষিজমি কিংবা জলাশয় সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ ছিল না। এবার টিডিআর পলিসির (ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইটস) প্রস্তাব করেছি। এছাড়া ঢাকার ভেতরে ৫৬৬ কিলোমিটার নদীপথ নতুন করে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা প্রস্তাবের পাশাপাশি সিএস এবং আরএস রেকর্ড অনুযায়ী খালগুলোকে পুনরুদ্ধার করে ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করার কৌশলও আছে নতুন ড্যাপে।
ড্যাপে ব্লকভিত্তিক নগরায়নের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে জানিয়ে আশরাফুল ইসলাম বলেন, তিন কাঠা ও পাঁচ কাঠায় কোনো ভবন তৈরি না করে ছোট ছোট ব্লক আকারে ভবন নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। যেন সে ব্লকের ভেতরে কমিউনিটির ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার জন্য একটি বড় খেলার মাঠ থাকে। এছাড়া আমরা নগর গণপরিবহনকে প্রাধান্য দিচ্ছি। বাসরুট রেশনালাইজেশনের কাজ চলছে। ঢাকার ভেতরে পাঁচটি মেট্রো লাইন ও দুটি বিআরটি লাইনের প্রস্তাব দিয়েছি। ঢাকার যানজট নিরসনে তিনটি রিং রোডের প্রস্তাব হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর খালগুলো পুনরুদ্ধার করে পানিপথে যাতায়াত ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাবও আছে।
ড্যাপ সংশোধনে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়ে অন্যতম অংশীজন ছিলেন পরিবেশবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব।
নতুন এ ড্যাপ গেজেট এবং তা বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, গত ৫ অক্টোবর ড্যাপ নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর সঙ্গে অন্যান্য অংশীজনদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গেজেট প্রকাশের আগে জাতীয় সম্মেলন হবে। সম্মেলনের সাত দিন আগে প্রত্যেক অংশীজনদের একটি করে ড্যাপের কপি দেওয়ার কথা। তখন আমরা তা পর্যালোচনা করবো। জাতীয় সম্মেলনে মতামত দেবো। সবাই সম্মতি দিলে এ ড্যাপ গেজেট হবে। জাগোনিউজ২৪