আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপ ঠেকাতে ভবন নির্মাণে যে কাজ করতেই হবে

সংক্রান্ত বাংলাদেশের আগের ইতিহাস এবং পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, ভারত ও মিয়ানমারে ঘটা ভূমিকম্পের কারণে বাংলাদেশের ভূখণ্ড কেঁপে ওঠার যে অভিজ্ঞতা আছে, তা মনে করিয়ে দেয় যে আমরা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বসবাস করছি। ইউরেশিয়া, ইন্ডিয়া ও চায়না প্লেট—তিনটি বাংলাদেশকে ঘিরে অবস্থান করায় এদের মধ্যে যুগের পর যুগ ধরে ঠোকাঠুকিতে অনেক ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে বলে বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে। এই ঝুঁকির ক্রমানুসারে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) ২০২০ বাংলাদেশকে চারটি জোনে ভাগ করেছে, যার মধ্যে ঢাকা দ্বিতীয় জোনে অবস্থিত। ঢাকাসহ দেশের সব শহরে ভবনগুলো ভূমিকম্পের কথা হিসাবে রেখে গুরুত্বসহ ডিজাইন করা দরকার।

বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকায় দেশের অধিকসংখ্যক মাঝারি ও উঁচু ভবন নির্মিত হচ্ছে। ঢাকায় ভবন করতে একটি নকশা বা প্ল্যান রাজউকে জমা দিতে হয়। রাজউকের বিজ্ঞ স্থপতিরা সেই প্ল্যান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যদি সবকিছু তাঁদের বিধিমালা মেনে করা হয়ে থাকে, তবে অনুমোদন দেন। যদি কোনো রকম ত্রুটি থাকে, তবে আবেদনকারীকে পুনরায় প্ল্যানটি জমা দিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু ভবনটির কাঠামো ডিজাইন-সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র রাজউক থেকে জমা দিতে বলা হয় না বলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগই নেই। এ কারণে ভবনের প্ল্যানটি অনুমোদন পেয়ে ভবন নির্মাণের সময় নির্মাতাকে কোনো পর্যায়ে নির্মাণসংক্রান্ত জবাবদিহি করতে হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভবন ডিজাইন করা হয় যেসব ফার্ম বা ব্যক্তিবিশেষ দিয়ে, এর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু, তা যাচাই-বাছাই করার সুযোগই বর্তমান রাজউকের বিধিমালায় নেই।

বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। ভূমিকম্পের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রায় প্রতিটি আবাসিক ভবনে সফট স্টোরি সমস্যা আছে, অনেক ভবনে বিমের চেয়ে কলাম দুর্বল করে নির্মিত, অনেক ভবনে বিম ব্যবহার না করে ফ্ল্যাট স্ল্যাব দিয়ে নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে সফট স্টোরি সমস্যা নেই—এমন আবাসিক ভবন পাওয়া যাবে না। এ সমস্যা অত্যন্ত গুরুতর।

কাঠামোগত ডিজাইন সম্পর্কে উদাসীনতার কারণে ঢাকা শহরে হাজার হাজার ভবন কয়েকটি ত্রুটি নিয়ে নির্মিত হয়ে চলেছে। ত্রুটি ছাড়া আবাসিক ভবন খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আগেই বলেছি, বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। ভূমিকম্পের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রায় প্রতিটি আবাসিক ভবনে সফট স্টোরি সমস্যা আছে, অনেক ভবনে বিমের চেয়ে কলাম দুর্বল করে নির্মিত, অনেক ভবনে বিম ব্যবহার না করে ফ্ল্যাট স্ল্যাব দিয়ে নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে সফট স্টোরি সমস্যা নেই—এমন আবাসিক ভবন পাওয়া যাবে না। এ সমস্যা অত্যন্ত গুরুতর।

আবাসিক ভবনের নিচতলাটি ফাঁকা রেখে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। নিচতলাটিতে শুধু কলাম থাকে। কলামের সঙ্গে তাকে সাহায্যকারী কোনো ওয়াল বা দেয়াল থাকে না। ওপরের বসবাসের তলাগুলোয় পাঁচ ইঞ্চির পরিমাপের অনেক দেয়াল থাকে। এই দেয়ালগুলো থাকায় বসবাসের তলাগুলোর ভূমিকম্প প্রতিরোধের সক্ষমতা নিচের কার পার্কিংয়ের তলার চেয়ে বেশি। কার পার্কিংয়ের তলাটির সক্ষমতা ওপরের বসবাসযোগ্য তলার চেয়ে শতকরা ৩০ ভাগ কম হলে তখন কার পার্কিংয়ের তলাটি অতিশয় ঝুঁকিপূর্ণ, যেটাকে প্রকৌশলের ভাষায় সফট স্টোরি বলে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে কার পার্কিংয়ের তলাটিতে কলামের সঙ্গে উইং ওয়াল, শেয়ার ওয়াল ও ব্রেসিং নির্মাণ করতে হয়। ঢাকার কোনো ভবনে এমন দেখা যায় না। অনেক ভবনে বিমের চেয়ে কলামকে দুর্বল করে নির্মাণ করা হয়। এর ফলে ভূমিকম্প হলে কলাম বিধ্বস্ত হয়ে ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। ফ্ল্যাট স্ল্যাব দিয়ে অনেক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, যেটা অতিশয় ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, সে ক্ষেত্রে ফ্ল্যাট স্ল্যাবটি কলামের চেয়ে অতিশয় শক্তিশালী হওয়ায় কলামকে সহজেই বিধ্বস্ত করবে যদি ভূমিকম্প হয়।

র লোকবলের মধ্যে ভবনের কাঠামোগত ডিজাইন চেক করার জনবল অপ্রতুল। কিন্তু আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে রাজউক সহজেই কাজটি করতে পারে। কয়েকটি শর্ত পূরণ করার বাধ্যবাধকতা রেখে এলাকাভিত্তিক এমন কয়েকটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রাজউক নিয়োগ করতে পারে। একটি ভবনের প্ল্যান জমা দিলে এর সঙ্গে যে কাঠামোর ডিজাইন জমা দেওয়া হবে, তা ওই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দিয়ে চেক করাতে হবে। চেক করার ফি জমাদানকারীর কাছ থেকে জমা দেওয়ার সময় নিয়ে নিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ১ হাজার ৫০০ বর্গফুটের দশতলা একটি ভবনের মোট ১৫ হাজার বর্গফুটের জন্য ওই ভবনের কাঠামোগত ডিজাইন চেক করার ফি ১০ টাকা হিসাবে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা হতে পারে। এটা নিবন্ধকারের ব্যক্তিগত মতামত। এর কমবেশিও হতে পারে, যেটা রাজউক ঠিক করবে।

ঘটেছিল যে ভূমিকম্প (দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক, মাত্রা ৮ দশমিক ১), তা যদি পুনরায় ঘটে, তবে ঢাকা তখনকার মতো কাঁপবে এবং বেশির ভাগ ভবনের দাঁড়িয়ে থাকার সক্ষমতা থাকবে না। একটি প্রলয় ঘটে যাবে। মানুষ বাস করে যে ভবনে, ভূমিকম্পে প্রাণহানি এড়াতে সেই ভবন ভূমিকম্প প্রতিরোধের ক্ষমতা নিয়ে নির্মাণ হওয়া জরুরি। প্রথম আলো

ড. আলী আকবর মল্লিক কাঠামো প্রকৌশলী, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ।