রাজধানীর মিরপুর এলাকার বাসিন্দা সাইদুল ইসলাম। প্রায় দুই যুগ ধরে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। অবসর নিয়ে তিনি এখন এক্সেসরিজ আমদানি করেন। পাশাপাশি সাব-কন্ট্রাক নিয়ে করছেন পোশাক তৈরির কাজ। বহুদিনের ইচ্ছা রাজধানীতে একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই বা নিজের ফ্ল্যাটের। প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন মিরপুর এলাকায় ফ্ল্যাট কেনার। কিন্তু বাধ সাধে লাগামহীন দাম। বর্তমানে প্রতি স্কয়ার ফুটে প্রায় এক হাজার টাকা বেশি চাওয়ায় তার সব হিসাব এখন গরমিল।
সাইদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমি একটা নির্দিষ্ট অর্থ ফ্ল্যাটের জন্য রেখেছিলাম। কিন্তু এখন অতিরিক্ত দাম চাওয়ায় আমার ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না। রড-সিমেন্টের দাম কমলে ফ্ল্যাটের দাম কমতে পারে। তখন আবার ভাবতে হবে।
একই কথা জানান চিকিৎসক দম্পতি ফারুক হাসান ও উম্মে হাবিবা হাসান এবং আইনজীবী শিরিন আক্তার। আর আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি মাসে যেখানে গড়ে প্রায় দুই হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি হয় সেখানে গত এক মাসে এই হার বলা চলে শূন্যের কোঠায়।
নির্মাণশিল্পের অপরিহার্য উপকরণ রডের দাম এ যাবতকালের সব রেকর্ড ভেঙেছে। গত দুই সপ্তাহে প্রতিটন রডে বেড়েছে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। খুচরা বাজারে প্রতিটন রডের দাম ছাড়িয়েছে ৯০ হাজার টাকা। রেকর্ড দামে বিক্রি হচ্ছে সিমেন্ট। আর দেড় মাসের ব্যবধানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে বিল্ডিং মেটেরিয়ালের দাম। বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে ইট, খোয়া আর বালি।
এতদিন চালু থাকা প্রকল্পের কাজ প্রায় অর্ধেকে নেমেছে বলে জানান নির্মাণশিল্প সংশ্লিষ্টরা। তাদের শঙ্কা, লাফিয়ে লাফিয়ে নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্পে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের দাম প্রতি স্কয়ার ফুটে ন্যূনতম ৮শ থেকে এক হাজার টাকা বা তার বেশি বাড়তে পারে। পাশাপাশি আবাসনের সঙ্গে জড়িত ২৬৯টি খাতের প্রায় ৪০ লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
নির্মাণসামগ্রীর দাম ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় থমকে গেছে নির্মাণকাজ। আবাসনে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি। আবাসন কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগও গেছে আটকে। আর সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় লোকসানের আশঙ্কায় ছোট আবাসন কোম্পানিগুলো তাদের রেডি ফ্ল্যাট বিক্রি করছে না। আরও কিছুদিন বাজার পরিস্থিতি দেখে হয়তো বিক্রির সিদ্ধান্ত নেবেন তারা। অন্য বড় কোম্পানিগুলোর রেডি প্রকল্পেও ক্রেতার দেখা মিলছে না। ক্রেতাদের একটা বড় অংশই ভাবছেন, সবকিছুর দাম সাধ্যের মধ্যে হলেই কিনবেন।
দ্য বেঙ্গল অব ক্রিয়েশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সোহেল রানা বলেন, আমরা সব সময়ই ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করি বিক্রির জন্য। তবে বর্তমানে ক্রেতার তেমন আগ্রহ নেই। ক্রেতারা একটু টানে বা টাকা পয়সার সমস্যায় আছে। মানুষ ফ্ল্যাট তখনই কেনে যখন সবকিছু ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। বিক্রেতারাও অর্থ সংকটে রয়েছেন।
তিনি বলেন, রডের দাম বিশ্বব্যাপী বেড়েছে, আমাদের দেশেও বেড়েছে অস্বাভাবিকহারে। তবে সিমেন্টের দামটা এত কেন বাড়লো এটা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন রয়েছে। এ দামটা আমাদের দেশেই শুধু বেড়েছে, এর যৌক্তিক কারণ আমরা এখনো খুঁজে পাইনি। দেশে শুধু সিমেন্ট না, সিরামিক আইটেম, বিল্ডিং মেটেরিয়ালসের দামও অস্বাভাবিক বেড়েছে। এতে প্রতি স্কয়ার ফুটে ১৬শ টাকা পর্যন্ত যৌক্তিকহারে দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এভাবে দাম বাড়ার কারণে আপনার পাঁচ হাজার টাকা স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাট সাড়ে ছয় হাজার বা সাত হাজার টাকা দিয়ে কিনতে হবে ক্রেতাকে। এতে স্বাভাবিকভাবেই ক্রেতা তার কেনার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবে, এটাই বাস্তবতা। সে হিসেবে বাজারে আমরা সংকটেই আছি।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব সূত্র জানায়, প্রতি বছর দেশে ২২ হাজার ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়। এর ব্যত্যয় ঘটেছিল শুধু ২০২০ সালে। ওই সময় করোনা ভাইরাসের মহামারিতে আবাসনেও মন্দা লেগেছিল। অপরদিকে ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি না হওয়ায় কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের টাকাও আটকে গেছে। এতে সংকটে পড়েছে কোম্পানিগুলো। হিসাব বলছে, গত এক মাসে গড়ে ১৮শ ফ্ল্যাট অবিক্রিত রয়েছে। মূলত ক্রেতার দেখা না মেলায় এসব ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়নি।
এসব বিষয়ে কথা হয় রিহ্যাবের সহ-সভাপতি (প্রথম) কামাল মাহমুদের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় অনেকটা থমকে গেছে নির্মাণকাজ। লাফিয়ে লাফিয়ে রড, সিমেন্ট, ইট, বালিসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্পে নির্দিষ্টের চেয়ে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। ব্যয় বাড়লে এর প্রভাব ক্রেতার ওপরও পড়ে। এতে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের দাম প্রতি স্কয়ার ফুটে ন্যূনতম আটশ থেকে ১১শ টাকা বাড়তে পারে। গত এক মাসে ফ্ল্যাট বিক্রি প্রায় শূন্যের কোঠায়।
তিনি আরও বলেন, আবাসনের সঙ্গে জড়িত ২৬৯ লিংকেজ শিল্প প্রসারের মাধ্যমে সমগ্র নির্মাণখাত জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সব পণ্যের দামতো আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়েনি। যেগুলোর দাম বাড়েনি কিন্তু আমাদের দেশে বেড়েছে সে সব বিষয়ে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। এটা না হলে নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক দামের প্রভাব পড়বে ৪০ লাখ শ্রমিকের উপর। জাগোনিউজ২৪