আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
ক্ষমতাবান স্বামী–স্ত্রীদের প্লট দিতে পাল্টে যাচ্ছে রাজউকের বিধি

সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী নিজে ঢাকায় রাজউকের একটি প্লট পেয়েছেন। তাঁর স্ত্রী ফাহিমা খাতুন পেয়েছেন আরেকটি প্লট। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, স্বামী-স্ত্রী দুজনের দুটি প্লট নেওয়ার সুযোগ নেই। যেকোনো একটি প্লট ছাড়তে হবে এই দম্পতিকে। কিন্তু উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী কোনো প্লটই ছাড়তে চান না।

অভিযোগ উঠেছে, রাজউক এখন এ-সংক্রান্ত বিধিমালাই বদলে ফেলছে। সংস্থাটির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বিধিমালার নতুন খসড়ায় স্বামী-স্ত্রীর নামে পৃথক দুটি প্লট বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। খসড়াটি অনুমোদন পেলে সংসদ সদস্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী ফাহিমা খাতুনের পাশাপাশি অন্য প্রভাবশালী দম্পতিরাও এই সুবিধা নিতে পারবেন।

এর আগে উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীকে প্লট দেওয়ার ক্ষেত্রে কিস্তি পরিশোধে বিলম্বজনিত জরিমানা মওকুফ এবং তুলনামূলক ছোট প্লট পাল্টে বড় প্লট নেওয়ার সুবিধা দিয়েছে রাজউক।

জানতে চাইলে গত ৩ জুন উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, তাঁর স্ত্রী একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর আলাদা কর হিসাব (ট্যাক্স ফাইল) রয়েছে। সম্পদের হিসাবও দুজনের আলাদা। তাই তিনি চান, নিজের ও তাঁর স্ত্রীর নামে দুটি প্লটই থাকুক।

দুজনকে প্লট দেওয়ার ব্যাপারে রাজউক কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন আরও অনেকেই আছেন (স্বামী-স্ত্রীর নামে পৃথক প্লট চান)। তবে রাজউক থেকে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

এদিকে সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে বিধিমালার একটি খসড়া তৈরি করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে রাজউক। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আইন উপদেষ্টা (অতিরিক্ত সচিব) আবদুন নূর মুহম্মদ আল ফিরোজ গত রাতে বলেন, খসড়াটি মন্ত্রণালয়ে এসেছে। তবে এ নিয়ে এখনো কোনো বৈঠক হয়নি।

কোথায় প্লট, আয়তন কত

রাজউকের তথ্য অনুযায়ী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী পূর্বাচলে ১০ কাঠার একটি প্লট পেয়েছেন। এর আগে তাঁর স্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক) উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরে তিন কাঠার একটি প্লট পান। সংসদ সদস্যের প্লটের ইজারা দলিল এখনো সম্পন্ন হয়নি। তিনি জানান, তাঁর স্ত্রী প্লট পেয়েছেন যৌথভাবে, উত্তরায়। অনেক আগে ওই প্লটের দলিল সম্পন্ন হয়েছে।

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটি কোনো আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করলে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে প্লট বরাদ্দ দেয়। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদন করেই উত্তরায় প্লট পেয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন।

উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী প্লট পেয়েছেন বিধিমালার ১৩/এ ধারা অনুসারে। ধারাটি ‘সংরক্ষিত কোটা’ হিসেবে পরিচিত। ওই ধারা অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে অবদান, জনসেবা ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কারণে সরকার কোনো ব্যক্তিকে প্লট দিতে পারে। সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয় রাজউকের বোর্ড সভায়।

রাজউকের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয় ‘দি ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ল্যান্ড অ্যালটমেন্টস) রুলস, ১৯৬৯’ অনুসারে। এই বিধিমালায় বলা আছে, স্বামী-স্ত্রী দুজনের দুটি প্লট পাওয়ার সুযোগ নেই। প্লটের আবেদনকারী ব্যক্তির নিজের নামে, স্বামী বা স্ত্রীর নামে কিংবা নির্ভরশীলদের নামে রাজউকের আওতাধীন এলাকায় কোনো আবাসিক প্লট কিংবা বাড়ি থাকলে কিংবা তাঁদের কেউ রাজউক, সরকার বা সরকারের রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কোনো প্লট বরাদ্দ পেলে ওই আবেদনকারী আর প্লট পাবেন না।

রাজউকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্বামী-স্ত্রীর দুটি প্লট থাকার বিষয়টি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একজনের প্লট বাতিল করে দেওয়া হয়। তবে এ ক্ষেত্রে বরাদ্দপ্রাপ্তরা কোন প্লট ছাড়তে চান, তা জানানোর সুযোগ দেওয়া হয়।

রাজউকের প্লট বরাদ্দের বিধিমালা (১৯৬৯ সালের) অনুসারে, একই পরিবারের দুজন যাতে দুটি প্লট না পান, সে জন্য জমি বরাদ্দ নেওয়ার সময় আবেদনকারীকে প্রথম শ্রেণির একজন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে হলফনামা দিতে হয়। এর মাধ্যমে জানাতে হয়, আবেদনকারীর নিজের বা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্যের রাজউক এলাকায় কোনো প্লট নেই। কেউ মিথ্যা তথ্য দিলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

প্লট বরাদ্দ নেওয়ার জন্য ২০১৩ সালে এমন একটি হলফনামা দিয়েছিলেন উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। এতে তিনি উল্লেখ করেন, তাঁর নিজের নামে আগে কখনো প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তবে তাঁর স্ত্রী বা নির্ভরশীলদের কেউ প্লট বরাদ্দ পেয়েছিলেন কি না, সে তথ্য হলফনামায় উল্লেখ করা হয়নি।

সূত্র জানিয়েছে, রাজউকের কর্মকর্তারা পরে জানতে পারেন, সংসদ সদস্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর স্ত্রীর নামেও প্লট আছে। এরপর ২০১৯ সালে উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রীর নামে প্লটের বিষয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা জানতে চায় রাজউক। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় ও রাজউক চিঠি চালাচালি করে। পরে গত মার্চে রাজউকের বোর্ড সভায় বিষয়টি আলোচনার জন্য তোলা হয়।

নথিপত্র বলছে, আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে রাজউকের প্লট বরাদ্দবিষয়ক বিধিমালা সংশোধন করার পর আবারও সংসদ সদস্য ও তাঁর স্ত্রীর প্লটের বিষয়টি আলোচনার জন্য বোর্ড সভায় তোলা হবে।

প্লট বরাদ্দের বিধিমালার নতুন খসড়া তৈরির প্রক্রিয়াটি হয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের বর্তমান সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী রাজউকের চেয়ারম্যান থাকার সময়ে। গত ৪ জুন তিনি রাজউকের চেয়ারম্যান পদ থেকে বদলি হয়ে সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিব পদে যোগ দেন।

সংসদ সদস্য ও তাঁর স্ত্রীকে দুটি প্লট দেওয়ার জন্যই বিধিমালা সংশোধন করা হচ্ছে—এমন অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে বদলির আগে আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, এসব মিথ্যা, গুজব। খসড়াটি চূড়ান্ত করার আগে প্রকাশ করা হবে এবং সবার মতামত নেওয়া হবে।

অবশ্য রাজউক সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ে পাঠানো খসড়াটি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। সাধারণত এ ধরনের বিধিমালা করার ক্ষেত্রে তা ওয়েবসাইটে দিয়ে অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়।

রাজউকের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা গত সোমবার বলেন, খসড়াটি সম্পর্কে এবং সংসদ সদস্য ও তাঁর স্ত্রীর প্লটের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তিনি রাজউকের দায়িত্ব নেওয়ার পর এ ব্যাপারে কোনো আলোচনা হয়নি।

সাধারণ মানুষের প্লট দ্রুত বাতিল

হাতে থাকা নথি অনুযায়ী, অন্তত তিন বছর আগে রাজউক জেনেছে যে উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী ফাহিমা খাতুনের নামে দুটি প্লট আছে। রাজউকের বোর্ড সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু কারও প্লট বাতিল করা হয়নি। তবে অন্যদের ক্ষেত্রে এমন হয় না। চলতি বছরে রাজউকের প্রথম বোর্ড সভায়ও তিন দম্পতির দুটি করে প্লটের বিষয় আলোচনায় ওঠে।

এর মধ্যে এ কে এম আখতারুজ্জামান ও হোসনে আরা আখতার দম্পতি এবং কাজী বিজলী বেগম ও সফিউল্লাহ ভূঁইয়া দম্পতিকে দুটি করে প্লটের মধ্যে তাঁরা কোনটি ছাড়তে চান তা জানতে চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। অন্যদিকে নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ ও নাজিরা আহমেদ দম্পতির একটি প্লট বাতিল করে দেওয়া হয়।

সংসদ সদস্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী ফাহিমা খাতুনের ব্যাপারে কেন একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো না জানতে চাইলে রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে। উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। বিষয়টি স্পর্শকাতর, তাই বাতিল করা হয়নি। এ ব্যাপারে সরকার যে নির্দেশনা দেবে, তা-ই হবে।

তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর প্লটের নথিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্লট বরাদ্দ পাওয়ার কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।

‘নজিরবিহীন’ সুবিধা

রাজউকের নথি অনুযায়ী, উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীকে আগে কিছু সুবিধা দিয়েছে রাজউক। ২০১১ সালে সাড়ে ৭ কাঠা আয়তনের একটি প্লটের বরাদ্দপত্র পেয়েছিলেন তিনি। পরে তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে প্লটের আয়তন বাড়িয়ে ১০ কাঠা করা হয় এবং নতুন বরাদ্দপত্র দেওয়া হয়। বরাদ্দপত্র অনুযায়ী, রাজউক পূর্বাচল প্রকল্পের ৩০ নম্বর সেক্টরের ১২৫ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর প্লটটি তাঁর।

নিয়ম অনুযায়ী, রাজউক থেকে প্লট বরাদ্দ পেলে মোট তিন কিস্তিতে টাকা শোধ করতে হয়। প্রথম কিস্তির টাকা নির্দিষ্ট মেয়াদে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে রাজউকের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে সর্বোচ্চ সাত বছরের মধ্যে তা দিতে হয়। তবে এ ক্ষেত্রে প্রায় ১২ শতাংশ হারে সুদ দেওয়া লাগে।

অবশ্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর প্লটের ক্ষেত্রে ভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। কারণ, প্লট বরাদ্দ পাওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রথম কিস্তির টাকা শোধ করেননি এই সংসদ সদস্য। পরে রাজউকের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে সুদ দেওয়া ছাড়াই প্রথম কিস্তির টাকা জমা দেন উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী।

রাজউকের কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের সুবিধা একেবারেই নজিরবিহীন। নির্ধারিত সময়ের পর সুদ ছাড়া কিস্তি পরিশোধের সুবিধা এই সংসদ সদস্যের বাইরে আর কাউকেই দেয়নি রাজউক।

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সুবিধা দেওয়ার জন্য রাজউকের বিধিমালা পরিবর্তনের উদ্যোগ নিন্দনীয়। বিধিমালায় এমন পরিবর্তন হলে বৈষম্য বাড়বে, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই রাজউকের উচিত এই উদ্যোগ থেকে সরে আসা। তিনি বলেন, রাজউক সরে না এলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এমন বিধিমালা পাস করা উচিত হবে না। প্রথম আলো