জমি কেনাবেচায় বর্তমানের মৌজা দর পদ্ধতির পরিবর্তে বাজারদর করার ব্যাপারে সাত সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করেছে সরকার। মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গতকাল রোববার এ উপকমিটি গঠন করেছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন যুগ্ম সচিব এ উপকমিটির আহ্বায়ক হবেন। এ ছাড়া ভূমি মন্ত্রণালয়; নিবন্ধন অধিদপ্তর; বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ); আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রতিনিধিরা এই উপকমিটিতে থাকবেন।
উপকমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, নিবন্ধন অধিদপ্তর উপকমিটিকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে দেবে। উপকমিটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনাসহ প্রতিবেদন তৈরি করবে। এ বছরের ১ ডিসেম্বরের মধ্যে উপকমিটি প্রতিবেদন দাখিল করবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে।
সূত্র জানায়, জাতীয় কমিটির ২৬তম বৈঠকে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, উচ্চ মূল্যের জমির দাম অনেক কম দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ বৈধ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অনেক বৈঠক করলেও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাওয়ায় তা উদ্ধার করে আনার চেয়ে পাচার রোধ করা ভালো। জমি নিবন্ধন বাজারভিত্তিক হলে মানি লন্ডারিং কমে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বৈঠকে বলছিলেন, জমি নিবন্ধনের সময় প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে কম মূল্যে নিবন্ধন করা হয়। এতে অনেক সময় বৈধ অর্থ অবৈধ হয়ে যায়। বাজারভিত্তিক লেনদেনের মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
বর্তমানে মৌজা দর (রেট) অনুযায়ী জমি কেনাবেচা বা নিবন্ধন হয়। মৌজা দর মানে হচ্ছে সর্বনিম্ন দর। অর্থাৎ কম দাম দেখিয়ে কেউ জমি কেনাবেচা করতে পারবেন না। মৌজা দর নির্ধারণের কাজ হয় ‘সর্বনিম্ন বাজারমূল্য বিধিমালা’ অনুযায়ী। সারা দেশের বিভিন্ন এলাকার মৌজা দর সর্বশেষ নির্ধারণ করা হয় ২০১৬ সালে, যা এখনো বহাল।
বিধিমালা অনুযায়ী, বাজারমূল্য নির্ধারণ করে একটি কমিটি। কমিটির মাধ্যমে দুই বছর পরপর বাজারমূল্য হালনাগাদ করা হয়। এ ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ে (২২ মাস) দলিলে উল্লেখ করা দামের (হস্তান্তর মূল্য) গড় করে নতুন বাজারদর নির্ধারণসংক্রান্ত প্রস্তাব তৈরি করা হয়। পরে মৌজা দর চূড়ান্ত করেন নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক।
নিবন্ধন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার গুলশান সাব–রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের অধীনে মৌজা আছে ১৪টি। এ ১৪ মৌজায় ৮ ধরনের জমি আছে। মৌজা দর অনুযায়ী, ধরনভেদে এ এলাকার ১ শতাংশ জমির দাম ১ লাখ থেকে ৫৮ লাখ টাকা। কিন্তু গুলশানের কোথাও কোটি টাকা শতাংশের নিচে জমি কেনাবেচা হয় না। ধানমন্ডি এলাকার মৌজা দর অনুযায়ী ১ শতাংশ জমির দাম হতে হবে ৪৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩০০ টাকা। কিন্তু বাস্তবে ধানমন্ডির কোথাও এ দামে জমি বেচাকেনা হয় না।
জমি নিবন্ধনে বর্তমানে জমির ক্ষেত্রে স্ট্যাম্প ডিউটি দেড় শতাংশ, নিবন্ধন মাশুল ১ শতাংশ, স্থানীয় সরকার কর ৩ শতাংশ ও এলাকাভেদে ১ থেকে ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) দিতে হয়। আবার প্রতিষ্ঠানের জমি-ফ্ল্যাট কেনাবেচা হলে যোগ হয় আরও ৪ শতাংশ উৎসে কর। নিবন্ধন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জমি নিবন্ধন থেকে সরকার বছরে সাত থেকে আট হাজার কোটি টাকা আয় করে। বাজারমূল্য পদ্ধতি করা হলে সরকারের আয় দ্বিগুণের কাছাকাছি হবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত চারটি বৈঠক হলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। জমির প্রকৃত বাজারদর ও মৌজা দরের তারতম্য দুর্নীতি উৎসাহিত করে জানিয়ে ২০২০ সালের ২৩ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে বাজারমূল্য নির্ধারণ বিধিমালা সংশোধনের সুপারিশ করা হয়।
এদিকে অর্থমন্ত্রী গত ১৫ জুন ক্রয় কমিটির বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বর্তমানে প্রতিটি মৌজার জন্য দাম ঠিক করে দেওয়া আছে, এর বেশি দামে নিবন্ধন করা যাবে না। কারণ, সেখানে কালোটাকা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রথম আলো