আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
রাজউকে অনিয়মকে বৈধতা দিতে তোড়জোড়

সরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা রাজধানীর পরিকল্পিত আবাসিক এলাকাগুলোর মধ্যে গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরা অন্যতম। কিন্তু এসব এলাকা এখন অনেকটাই বাণিজ্যিক এলাকায় রূপ নিয়েছে। মূলত রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) উদাসীনতা ও তদারকির অভাবেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রাজউকের তথ্যই বলছে, এসব এলাকার অন্তত ১ হাজার ২৮১টি আবাসিক প্লট অবৈধভাবে বাণিজ্যিক বা অনাবাসিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী, আবাসিক প্লটে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানো নিষিদ্ধ। যাঁরা আবাসিক প্লট বরাদ্দ নিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো অনিয়মকে বৈধতা দিতে ওই চার এলাকার ভূমি ব্যবহারসংক্রান্ত নকশা সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়েছে রাজউক, যাতে অবৈধভাবে রূপান্তর করা বাণিজ্যিক প্লটগুলোকে বৈধতা দেওয়া যায়।

রাজউকের এই উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নগর-পরিকল্পনাবিদেরা। তাঁরা বলছেন, এর মাধ্যমে কার্যত অনিয়মকে উৎসাহ দেওয়া হবে। একই সঙ্গে রাজধানীর অন্য এলাকায় কেউ একই ধরনের অনিয়ম করলে ব্যবস্থা নেওয়ার নৈতিক অধিকার হারাবে রাজউক। পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকাগুলোর বাসযোগ্যতা আরও কমবে।

রাজউকের তথ্য অনুযায়ী, গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরা (প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব) এলাকায় মোট ১৬ হাজার ১৩৩টি প্লট আছে; এর মধ্যে উত্তরা প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বেই আছে ১১ হাজার ৫০৭টি প্লট। চার এলাকায় মোট প্লটের মধ্যে বাণিজ্যিক বা অনাবাসিক কাজে ব্যবহারের জন্য রাজউক অনুমোদিত প্লট আছে ৬৪৩টি। কিন্তু বাস্তবে অনাবাসিক কাজে ব্যবহার করা হয় ১ হাজার ৯২৪টি প্লট।

গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরার আবাসিক প্লটগুলোতে বিপণিবিতান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল, রেস্তোরাঁসহ নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় যানবাহনের যাতায়াত বেড়েছে। যার পরিণতি হচ্ছে যানজট ও শব্দদূষণ।

অনিয়মকে বৈধতা দিতে তোড়জোড়

আবাসিক প্লটের বাণিজ্যিক ব্যবহার সম্পর্কে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা বলেন, রাজউকের কোনো জবাবদিহি আসলে নেই। কিছু মানুষকে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ার জন্য গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরার আবাসিক প্লটের শ্রেণির পরিবর্তন করা শুধু বেআইনি হবে না, কাজটি অনৈতিকও। এমন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পেশাজীবীরা আপত্তি জানালেও রাজউক তা আমলে নিতে চায় না।

বনানীর সবচেয়ে ব্যস্ত সড়ক কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের দুই পাশে ছোট-বড় অসংখ্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও রেস্তোরাঁ রয়েছে। তবে এই সড়কের উত্তর অংশের বেশির ভাগ এলাকা এখনো ছিমছাম। তুলনামূলকভাবে নীরব ও পরিচ্ছন্ন, বেশির ভাগ প্লটেই আবাসিক বাড়ি। সড়কটির দক্ষিণাংশের অবস্থা উত্তরাংশের বিপরীত। এই অংশে আবাসিকের চেয়ে বাণিজ্যিক ভবনই বেশি। কিছু ভবনে মিশ্র ব্যবহারও (আবাসিক ও অনাবাসিক) রয়েছে।

রাজউকের তথ্য বলছে, বনানী এলাকার মোট আয়তন ৩০৭ দশমিক ৬৭ একর। এই এলাকায় প্রায় অর্ধেক এখন বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

নগর-পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান প্রথম আলোকে বলেন, কোনো আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিক ব্যবহার রাতারাতি হয় না। কিন্তু রাজউক দেখেও ব্যবস্থা নেয় না। রাজউকের উচিত ছিল আবাসিক প্লটের অবৈধ ব্যবহারকে চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া, সেটি তারা করেনি।

বনানীর মতোই অবস্থা গুলশানের। এই এলাকার মোট প্লটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এবং বারিধারা এলাকার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এখন বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাজউক সূত্রে জানা গেছে, বারিধারা এলাকায় মাত্র একটি প্লটের বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের অনুমোদন আছে। কিন্তু সেখানে ২২৮টি প্লট বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে গুলশানে অবৈধভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এমন বাণিজ্যিক প্লট আছে ৪৩৩টি। উত্তরায় অবৈধ বাণিজ্যিক প্লটের সংখ্যা ১০৭।

এসব প্লটের প্রায় প্রতিটিতে বহুতল ভবন আছে। রাজউক থেকে আবাসিক ভবনের অনুমোদন নিয়ে ভবনগুলো বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমন কার্যক্রম ঠেকানোর দায়িত্ব রাজউকের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ শাখার। এই শাখার শীর্ষ কর্মকর্তা ও রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাস বলেন, অবৈধভাবে প্লটের বাণিজ্যিক ব্যবহারসংক্রান্ত তথ্য তাঁর কাছে নেই।

নকশা সংশোধনের উদ্যোগ

প্লটের অবৈধ ব্যবহার ঠেকাতে না পেরে গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরা আবাসিক এলাকার মূল নকশা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে রাজউক। নাম না প্রকাশের শর্তে রাজউকের পরিকল্পনা শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, এখন অবৈধভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এমন আবাসিক প্লটগুলোর নকশা সংশোধনের মাধ্যমে তা বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তর করা হবে। ফলে প্লটগুলোর ব্যবহার কাগজ-কলমে বৈধ হয়ে যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা করা হবে। ইতিমধ্যে এ-সংক্রান্ত একটি নীতিমালার খসড়া করেছে রাজউক।

রাজউক সূত্র জানায়, আবাসিক থেকে বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরের ক্ষেত্রে গুলশান, বনানী, বারিধারা (জে ব্লক ছাড়া) এলাকায় প্রতি কাঠার জন্য এক কোটি টাকা করে ফি দিতে হবে। বারিধারা জে ব্লক এবং উত্তরা প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে প্লট রূপান্তরের ক্ষেত্রে কাঠাপ্রতি ৫০ লাখ টাকা ফি দিতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল-পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, আবাসিক এলাকায় যেভাবে বড় বড় বিপণিবিতান, হোটেল নির্মাণ করা হয়েছে, তা আবাসিক এলাকার চরিত্রের সঙ্গে যায় না। এমন অবস্থায় ভূমি ব্যবহার সংশোধন করে প্লটের ব্যবহার পরিবর্তন করলে অনিয়মকে বৈধতা দেওয়া হবে। প্রথম আলো