আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
ঢাকায় ফ্ল্যাট কেনা এখন মধ্যবিত্তের দুরাশা

জীবিকার তাগিদে গ্রাম থেকে শহরমুখী হয় মানুষ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আয় বাড়লে মধ্যবিত্তরা স্বপ্ন দেখেন মাথাগোঁজার ঠাঁইয়ের। অর্থাৎ শহরেই আবাসন সমস্যার সমাধান খুঁজতে থাকেন তারা। স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিল তিল করে সঞ্চয় করেন অর্থ। গড়ে তোলেন স্বপ্নের আবাস। কিন্তু আবাসনে নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় হু হু করে বেড়েছে ফ্ল্যাটের দাম। এতে ঢাকা বা বড় শহরে নিজের একটা বাড়ি বা ফ্ল্যাটের স্বপ্ন এখন অধরাই থেকে যাচ্ছে মধ্যবিত্তের।

যদিও উল্টো চিত্র ধনীদের। তথ্যমতে, বিলাসবহুল আবাসনের ব্যবসা এখন বেড়েছে। ধনীরা তাদের চাহিদার অধিক ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট কিনছেন। নিজের প্রয়োজনে ব্যবহারের পর বাকিগুলো দিচ্ছেন ভাড়া। উচ্চবিত্তদের স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে বাসা ভাড়ার ব্যবসাও এখন জমজমাট। ফলে রাজধানী ঢাকায় বাসা ভাড়া বেড়েছে লাগামহীনভাবে।

শুধু বাসা ভাড়াই নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্যে নাভিশ্বাস নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত সবারই। এ অবস্থায় টিকে থাকাটাই এখন বড় লড়াই। ফলে নিজস্ব আবাসনের স্বপ্ন ভুলে টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত মধ্যবিত্তরা। এরপরও নির্মাণসামগ্রীর দাম কমলে সবার জন্য আবাসন নিশ্চিত অসম্ভব নয় বলে মনে করেন আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা।

কথা হয় নাজমুস সাকিবের সঙ্গে। সরকারি এ চাকুরে পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস করেন রাজধানীর পরীবাগ এলাকায়। বেশ কয়েক বছর ধরে কিছু টাকা জমিয়েছেন নাজমুস সাকিব। ইচ্ছা কোনো একটি আবাসন কোম্পানি থেকে ডাউন পেমেন্ট দিয়ে কিস্তিতে ফ্ল্যাট কেনার। তবে বর্তমান বাস্তবতায় সেটা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন তিনি। কারণ, তার যে আয় তাতে সংসারের খরচ জুগিয়ে অন্য কোনো খাতে বাড়তি টাকা খরচ সম্ভব নয়।

জাগো নিউজকে নাজমুস সাকিব বলেন, ‘একটা সময় ভাবছিলাম ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকায় ফ্ল্যাট হয়ে যাবে। কয়েক লাখ টাকা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে বাকিটা কিস্তিতে পরিশোধ করবো। কিন্তু ফ্ল্যাটের দাম এখন ৮০ লাখের নিচে নেই। এরপর আবার নির্মাণসামগ্রীর যে দাম বেড়েছে, আগামীতে সেটা সমন্বয় করা হলে ফ্ল্যাটের দাম এক কোটি টাকায় উঠবে। একই সঙ্গে আছে সংসার খরচ। মাসে মাসে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। সবমিলিয়ে আমার পক্ষে আর ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব নয়। তাই নিজের ফ্ল্যাটের স্বপ্ন আপাতত দেখছি না, ভাড়া বাসায় চাকরির বাকি সময় কাটাতে হবে।’

একই কথা এক বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা মো. আব্বাসের। এরই মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গ্রামে বাড়ি করেছেন। এখন স্বপ্ন দেখেন ঢাকায়ই কিছু করার। তবে গত দু-তিন মাস ধরে সাধ্যের মধ্যে কোনো ফ্ল্যাট মেলাতে না পেরে তার স্বপ্ন এখন অধরাই থেকে যাচ্ছে।

শুধু বাসাভাড়া নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্যে নাভিশ্বাস নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত সবারই। এ অবস্থায় টিকে থাকাটাই এখন বড় লড়াই। ফলে নিজস্ব আবাসনের স্বপ্ন ভুলে টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত মধ্যবিত্তরা।

জাগো নিউজকে আব্বাস বলেন, ‘চাকরিজীবনের বাকি সময় কাটবে ভাড়া বাসায়ই। বাসাভাড়াও বাড়ছে প্রতি বছর। চাকরি শেষে হয়তো একটা গাড়ি হবে, তবে ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাট হচ্ছে না।’

আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ফ্ল্যাটের খরচ। ফলে বাধ্য হয়েই দাম বাড়াতে হচ্ছে। বেচা-বিক্রি খুব বেশি না হলেও কম দামে ছাড়া যাচ্ছে না কোনো ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট।

তথ্যমতে, মাত্র আড়াই বছরের ব্যবধানে রডের দাম বেড়েছে প্রতি টনে ৩৫ হাজার টাকা। ২০২০ সালে এক টন রড কিনতে খরচ হতো ৬৪ হাজার টাকা, ২০২১ সালে সেটা ৭০ হাজার টাকায় দাঁড়ায়। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে প্রতি টন রড বিক্রি হয় ৯৪ হাজার টাকায়। ২০২৩ সালে রেকর্ড তৈরি করে রডের দামে। এক টন রডের দাম ছাড়িয়েছে লাখ টাকা। একই সঙ্গে দাম বেড়েছে সিমেন্ট, বালু, পাথর, ইট, গ্রিল ও রেলিংয়ের। পাশাপাশি নিত্যপণের দাম বাড়ায় শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে।

আড়াই বছরের ব্যবধানে রডের দাম বেড়েছে প্রতি টনে ৩৫ হাজার টাকা। ২০২০ সালে এক টন রড কিনতে খরচ হতো ৬৪ হাজার টাকা। ২০২৩ সালে যা ছাড়িয়েছে লাখ টাকা।

এসব বিষয়ে কথা হয় আবাসন ব্যবসায়ী এবং রিহ্যাবের সাবেক সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভুইয়ার সঙ্গে। লিয়াকত আলী বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ডলার সংকট দেখা দেয় দেশে। অনেক ব্যাংক এলসি খুলতে পারছে না। রডের কাঁচামালের দামও বেড়েছে। ফলে রডের দামও বাড়তি। একই সঙ্গে বেড়েছে অন্য উপকরণের দাম। যার প্রভাব পড়েছে ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্টে। বলা যায়, দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় এখন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে মধ্যবিত্তের আবাসনের স্বপ্ন।’

মানুষের আয় ও আবাসনের চিত্র জানতে ২০২২ সালে ঢাকায় এক গবেষণা পরিচালনা করে রিহ্যাব। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা সেল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, মিরপুর, গুলশান, বনানী ও উত্তরা এলাকায় গবেষণা পরিচালনা করে। এতে দেখা যায়, যাদের আয় ২০ হাজার বা ২০ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ভরসা ৩ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে কোনো ঝুপড়ি ঘর। ওই ঘরে পরিবার নিয়ে কোনোরকমে থাকছেন তারা। যাদের আয় ২১ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে তারা থাকছেন ৬ থেকে ১০ হাজার টাকায়, সাবলেট। ৩১ থেকে ৪০ হাজার টাকা যাদের আয়, তারা থাকছেন ছোট আকারের কোনো ফ্ল্যাটে। যেগুলোর ভাড়া ১১ থেকে ১৪ হাজার টাকার মধ্যে।

যাদের আয় ৪১ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে তারা থাকছেন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা ভাড়ার ফ্ল্যাটে। যেগুলোর আয়তন এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ১৫০ স্কয়ার ফুট। ৫১ থেকে ৮০ হাজার টাকা আয়ের মানুষের ভরসা এক হাজার ১৫০ স্কয়ার ফুট থেকে এক হাজার ২০০ স্কয়ার ফুটের কোনো ফ্ল্যাট, যেগুলোর ভাড়া ২১ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে। ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা আয়ের মানুষ থাকছেন এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৫০০ স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাটে, যেগুলোর ভাড়া ৩১ থেকে ৪০ হাজার টাকা। তবে ভালো মানের এক হাজার ৫০০ স্কয়ার ফুট বা তার চেয়ে একটু বড় কোনো ফ্ল্যাটে থাকতে হলে অবশ্যই এক লাখ টাকার বেশি আয় করতে হবে তাকে। এসব ফ্ল্যাটের ভাড়া ৪০ হাজার টাকা বা তার চেয়ে বেশি।

ফ্ল্যাটের দাম বাড়ায় ভালো নেই আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরাও। কমেছে ফ্ল্যাট বিক্রি, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি আকারের ফ্ল্যাটের বিক্রি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর অন্যতম কারণ ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যাওয়া। যদিও উচ্চবিত্তদের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের বিক্রি বেড়েছে কিছুটা।

প্রতি বছর দেশে প্রায় ১৫ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি হয়। তবে চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের ছয় মাস পার হলেও ফ্ল্যাট বিক্রি তলানিতে। এর কারণ হিসেবে ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।

রিহ্যাব সূত্র জানায়, প্রতি বছর দেশে প্রায় ১৫ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি হয়। তবে চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের ছয় মাস পার হলেও ফ্ল্যাট বিক্রি তলানিতে। এর কারণ হিসেবে ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি নিত্যপণ্যের আকাশচুম্বী দামের কারণে সংসার চালানোর পর মানুষের হাতে বাড়তি অর্থ না থাকাকেও ফ্ল্যাট বিক্রি কমার কারণ হিসেবে দেখছেন তারা।

এ বিষয়ে আবাসন ব্যবসায়ী এবং রিহ্যাবের সাবেক সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, ‘এখন নির্মাণসামগ্রীর উচ্চদামের কারণে আবাসন খাতে ব্যবসা নেই। অর্থ বিনিয়োগ করে অলস বসে আছেন অধিকাংশ ব্যবসায়ী। মধ্যবিত্তের হাতে টাকা না থাকায় তারাও কিনতে পারছেন না ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট। তাছাড়া অনেকেই আবার নির্বাচন সামনে রেখে বুকিং দেননি, এখন হয়তো দিতে পারেন। তবে নির্মাণসামগ্রীর দাম কমে এলে এখনো মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে ফ্ল্যাট দেওয়া সম্ভব।’ জাগোনিউজ২৪