আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
রিয়েল এস্টেট সেক্টর : পথপ্রদর্শক শেল্টেক

আবাসন ও নগর ব্যবস্থাপনা হলো রিয়েল এস্টেট সেক্টরের মূল অনুষঙ্গ। বাংলাদেশে এই দুই খাতেই নানা সমস্যা সংকট বিদ্যমান। মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষদের বাসস্থান সমস্যার কোনো সুষ্ঠু সমাধান রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। নগর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও সরকারি উদ্যোগের সাফল্য খুবই সীমিত। ফলে এসব ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ নিজস্ব ব্যবস্থাপনার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিকশিত হয়েছে রিয়েল এস্টেট সেক্টর। অল্প সময়ের মধ্যে এই খাত সাফল্যের চূড়ায় আরোহণ করেছে। অর্থমূল্যে, মুনাফায় এটি এখন বিবেচিত হচ্ছে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত হিসেবে। বিভিন্ন হিসেবে বলা হচ্ছে, দেশের বার্ষিক গড় উৎপাদনে (জিডিপি) এর অবদান প্রায় ১৫ শতাংশ। কৃষি ও গার্মেন্টের পর এটিই এখন সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থান খাত বলেও দাবী করা হচ্ছে। তবে ২০১৩ সালের পর থেকে এই খাতে প্রবৃদ্ধির ধারায় নেই।
বাংলাদেশে রিয়েল এস্টেট-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ৭০ দশকের গোড়ার দিকে। তখন মাত্র পাঁচটি কোম্পানি এ ব্যবসার গোড়াপত্তন করেছিল। ইস্টার্ন হাউজিং এবং প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট সেই যাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছিল। আশির দশকের শেষদিকে এই ব্যবসায় গতি সঞ্চারিত হয়। আধুনিক চিন্তা চেতনা নিয়ে এই খাতের সম্প্রসারণে এগিয়ে আসেন উদ্যোক্তারা। বুয়েটের সহকারি অধ্যাপক তৌফিক এম সেরাজ এ সময় শিক্ষকতা ছেড়ে যোগ দেন আবাসন ব্যবসায়। ১৯৮৮ সালে গড়ে তোলেন শেল্টেক্ লিমিটেড। আবাসন খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, শেল্টেক্ যুক্ত হওয়ার পর থেকে এই খাত দ্রুত বিকশিত হতে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি নানামুখী কর্মকান্ডের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করা ও নতুন এই খাতটিকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য কাজ করতে থাকে। রিয়েল এস্টেট সেক্টরকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এই খাতের প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিমালা প্রণয়নেও ভূমিকা রাখেন প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা। তাদের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছে এই খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যন্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (রিহ্যাব)।
এভাবেই এগিয়েছে রিয়েল এস্টেট ও শেল্টেক্। একে অপরকে পথ দেখিয়েছে, হাত ধরে এগিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট সেক্টরকে শেল্টেক্ অনেক দিয়েছে, তেমনি এই খাতের বর্ধিত ব্যাপ্তি থেকে প্রতিষ্ঠানটি শিখেছেও অনেক কিছু। ফলে বর্তমানে দেড় সহস্রাধিক কোম্পানি ব্যবসা করছে এই সেক্টরে। এদের মধ্যে ১০৬৫টি রিহ্যাব-এর সদস্য। এই সময়পর্বে শুধু রিয়েল এস্টেট সেক্টরই বড় হয়নি, এই খাতের অন্যতম প্রধান পথপ্রদর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে শেল্টেক্। আবাসন শিল্পের প্রচার ও প্রসারে তাদের অবদান অনন্য। গ্রাহকদের কাছে শেল্টেক্ তাই একটি বিশ্বস্ত নাম। এই প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রেখে অনেকেই জমি কিনেছেন, বাড়ি নির্মাণ করছেন। তেমনি শেল্টেক্ও তাদের গ্রাহকের প্রতি দায়িত্বশীল। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি ৩০ বছর অতিক্রম করল। গ্রহকদের আস্তা অর্জনকেই এই ৩০ বছরের মূল পুঁজি হিসেবে বিবেচনা করছে এর উদ্যোক্তারা।
আবাসন খাত একটি ক্রমবর্ধমান আর্থিক খাত, তবে এই খাত ঘিরে সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকার অভিযোগও রয়েছে। রাজনীতির উত্থান-পতন, নীতিগত সহযোগিতার অভাব, শেয়ার বাজারের বেহাল দশা, প্রবাসী বিনিয়োগে ভাটা, ও ডেভেলপারদের ওপর অনাস্থা এই খাতকে এগুতে দিচ্ছে না। ধারাবাহিকভাবে ফ্ল্যাট এবং জমির মূল্য ঊর্ধ্বগতি ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতাকে অনেকটা নাজুক করে ফেলেছে। অন্যদিকে সরকারের আর্থিক নীতিমালার সংকটের ফলে শেয়ার বাজারসহ আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো এই ব্যবসাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে পারছে না।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব সূত্রে জানা গেছে, বলছে, এ খাতের বাজারের ৭৫ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে শীর্ষ ২০টি প্রতিষ্ঠান। রিয়েল এস্টট সেক্টরের ভালো-মন্দ প্রধানত এদের ওপরই নির্ভর করে। শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকেই বেশি দায় দায়িত্ব বহন করতে হয়। এই খাতের সংকটের প্রধান দায় এদের ওপরই এসে পড়ে। এরা হচ্ছে শেল্টেক্, ডমইনো, কনকর্ড, নাভানা রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়াস লিমিটেড (বিটিআই), ইস্টার্ন হাউজিং, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (এসইএল), শান্তা প্রপার্টিজ, সাউথ ব্রিজ, অ্যাশিউরেন্স, এএনজেড, আরবান ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, কমপ্রিহেনসিভ হোল্ডিংস লিমিটেড, অ্যাসেট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড হোল্ডিং লিমিটেড, রূপায়ন, আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন, র‌্যাংগস প্রপার্টিজ, এনা প্রপার্টিজ, হামিদ রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ও বে ডেভেলপমেন্টস।
প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই ২০১৩ সাল থেকে আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নানা দিক সমন্বয় করে টিকে থাকলেও সাম্প্রতিক মন্দা এই খাত থেকে অসংখ্য উদ্যোক্তাকে ছিটকে দিয়েছে। ছোট উদ্যোক্তারা অনেকেই অন্য পথে চলে গেছেন। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার যদি গৃহঋণের ওপর সুদের হার কমিয়ে হাউজিং ফাইন্যান্সিং আরও সহজ করে দেয় তাহলে দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। এছাড়া নিবন্ধন খরচ এবং বাড়ি ক্রয়ের ওপর আরোপিত ট্যাক্স না কমালে ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতা দিনে দিনে লোপ পাবে। তারা এও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, এই খাতের ওপর নির্ভর করে আছে এ দেশের প্রায় শতাধিক সহযোগী শিল্প, যেমন সিমেন্ট, সিরামিকস, রং, ইস্পাত, ইট, বালি, কাঁচ, আসবাবসহ অসংখ্য ভবনসজ্জা সংক্রান্ত শিল্প। অর্থনীতিকে নিরাপদ রাখার স্বার্থেই সরকারকে এই খাতের সুষ্ঠু বিকাশে সহযোগিতা করতে হবে।
তবে এই খাতের নানা বিষয় নিয়ে জনমনে বিভিন্ন প্রশ্ন আছে। বিশেষত আবাসন ব্যবসায় অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যয়ের প্রসঙ্গে অর্তনীতিবিদদের মধ্যে নানা দ্বিমত রয়েছে। কালো টাকা সাদা করার জন্য এই খাত কাজ করছে বলে অভিযোগ আছে। আবাসন ব্যবসায়িরা মানুষকে নানাভাবে ঠকানোর চেষ্টা করেছেন, এরকম খবরও কম আসেনি। জানা গেছে, বাজারে আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এই খাতে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়। উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ধরনের ফ্ল্যাট তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়। এরপর তারা এসব ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য প্রতিযোগিতায় নামে। কিন্তু হিসাব অনুযায়ী বিক্রি না বাড়ায় অবিক্রীত ফ্ল্যাটের সংখ্যা বেড়ে যায়। এ অবস্থায় ক্রেতা আকর্ষণে দাম কমানো হলেও পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি ঘটেনি। আবাসন খাতের এসব সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রেও পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে শেল্টেক্। প্রতিষ্ঠানের ৩০ বছরের অভিজ্ঞতাকে সামনে আনছে তারা।
প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা দাবি করেছেন যে, এই খাতে কিভাবে ব্যবসা করতে হবে সেটা শেল্টেক্ দেখিয়ে দিয়েছে। মান নিয়ন্ত্রণে শেল্টেক্ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়, ব্যবসায় নৈতিকতাকে তারা সামনে রাখে। এটা ছাড়া অগ্রসর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে তারা মনে করেন। প্রতিষ্ঠানেিক এগিয়ে নিতে হলে পেশাদারিত্বকে কেন্দ্রে রাখতে হবে বলেও মত দিয়েছে শেল্টেক্ পরিবার। বাংলাদেশে রিয়েল এস্টেট সেক্টরকে এখন সীমিত আয়ের মানুষদের মধ্যে যেতে হবে বলে মনে করছে তারা। এই কাজে ইতোমধ্যে তারা নেমেও পড়েছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, জনগণের চাহিদা বুঝে কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে পারাটাই রিয়েল এস্টে সেক্টরে আজকের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোই শুধু নয়, যে কোনো উদ্যোগেরই এ থেকে শেখার রয়েছে।

শেয়ার করুন