প্রথমার্ধে বাংলাদেশে বিতরণ হওয়া অটো লোনের ৪৫ শতাংশই দিয়েছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) লংকাবাংলা ফিন্যান্স লিমিটেড। জানুয়ারি থেকে জুন সময়ে নতুন ইস্যু হওয়া ক্রেডিট কার্ডের ২৪ শতাংশই ছিল তাদের। প্রথমার্ধ শেষে প্রতিষ্ঠানটির রিটেইল পোর্টফোলিও আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, দেশের এনবিএফআইগুলোর মধ্যে যা সর্বোচ্চ। ব্যাংক ও এনবিএফআই মিলিয়ে হিসাব করলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের বর্তমান পর্যায়ে দেশের উদীয়মান ভোক্তাশ্রেণীর মনোভাব, রিটেইল ফিন্যান্সের সম্ভাবনা ও নিজ ব্যবসায় উচ্চপ্রবৃদ্ধি নিয়ে সম্প্রতি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেন প্রতিষ্ঠানটির হেড অব রিটেইল ফিন্যান্স খোরশেদ আলম
প্রথমার্ধে রিটেইল ফিন্যান্সে আপনাদের উচ্চপ্রবৃদ্ধি দেখলাম…
রিটেইল ফিন্যান্সের আওতায় আমরা ব্যক্তিকে ছোট ছোট ঋণ দিয়ে থাকি। এ টাকায় তারা বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি, গাড়ি, মোটরসাইকেল, ইলেকট্রনিকসসহ যেকোনো ভোগ্যপণ্য কিনতে পারেন। ক্রেডিট কার্ডও রিটেইল ফিন্যান্সের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ব্যক্তিগত অন্য যেকোনো প্রয়োজনেও মানুষ আমাদের রিটেইল বিভাগ থেকে ঋণ নিতে পারেন।
আপনি ঠিকই জেনেছেন, কয়েক প্রান্তিক ধরে আমাদের রিটেইল ফিন্যান্স ব্যবসায় উচ্চপ্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। রিটেইলে আমরা ২০২০ সালে এনবিএফআই সেক্টরে এক নম্বর প্রতিষ্ঠান হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলাম। তবে বিভিন্ন রিটেইল প্রডাক্টে গ্রাহকদের কাছ থেকে এত ভালো রেসপন্স পেয়েছি যে, ২০১৭ সালের প্রথমার্ধেই আমরা সে লক্ষ্যে পৌঁছে গেছি। এরই মধ্যে আমাদের রিটেইল পোর্টফোলিও আড়াই হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। রিটেইল ফিন্যান্সের ব্যবসায় দেশে এখন আমাদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে মাত্র একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক।
যেকোনো আর্থিক সেবায় উচ্চপ্রবৃদ্ধির সঙ্গে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক যে প্রশ্নটি চলে আসে, এর গুণগত দিক…
আমি মনে করি, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে রিটেইলেই সবচেয়ে কম ঝুঁকি। তবে শর্ত থাকে যে, আপনি গ্রাহকের সামর্থ্য ও ঋণ পরিশোধের মানসিকতা সম্পর্কে ভুল অ্যাসেসমেন্ট করেননি। এজন্য চাই প্রশিক্ষিত ও পেশাদার একটি কর্মী বাহিনী। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রিটেইলে আমরা সেটি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি।
আমাদের কর্মীরা সঠিক গ্রাহক খুঁজে বের করেন। তার মাসিক আয়-ব্যয় পর্যালোচনা করে তাকে কত টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়া উচিত, এরও একটি সিলিং তারা মেনে চলেন। সর্বোপরি ঋণ পরিশোধে ব্যক্তির আন্তরিকতা সম্পর্কে একটি যথাযথ পূর্বানুমান করতে হয় তাদের।
বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) আমাদের জন্য কাজটি বেশ সহজ করে দিয়েছে। আগে কেউ ঋণখেলাপি হলেই শুধু তার তথ্য সিআইবি থেকে পাওয়া যেত। এখন একজন ব্যক্তি তার জীবনে অন্য কোনো ঋণ পরিশোধে কেমন আচরণ করেছেন, তারও একটি চিত্র উঠে আসে। সিআইবিতে কাউকে খেলাপি দেখালে আমরা তার কাছ থেকে দূরে থাকি। এর বাইরে কারো সিআইবি রিপোর্ট পরিচ্ছন্ন না হলে আমরা বোঝার চেষ্টা করি, ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা কি কোনো অসুবিধার কারণে তার মাসিক কিস্তি (ইএমআই) দিতে দেরি করেছিলেন, পরবর্তীতে সে সমস্যা কাটিয়ে উঠে তিনি কি তার বাকি কিস্তিগুলো ঠিকমতো দিয়ে গেছেন?
রিটেইল ফিন্যান্সিং ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, অনেক গ্রাহক তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক জীবনে সাময়িক চাপের মধ্য দিয়ে যান, একটু সাপোর্ট পেলেই তিনি তা উতরে যান। ঋণদাতার অধিকারগুলো রক্ষা করে এ সময়টাতে লংকাবাংলার টিম তাদের পাশে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব গ্রাহকই পরবর্তীতে তাদের ইএমআইগুলো পরিশোধে আন্তরিক থাকেন। আন্তরিকতার এ সম্পর্কটিই উচ্চপ্রবৃদ্ধির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক বলে আমি মনে করি।
ক্রেডিট কার্ডেই দেখুন না, বছরে ১৫টি লেনদেন করলে আমরা সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের বার্ষিক সার্ভিস চার্জটুকু নিই না। কোম্পানির জন্য বছর শেষে সম্মিলিত অংকটি নেহাত ছোট নয়। কিন্তু এ থেকে আমাদের সেরা প্রাপ্তি হলো, গ্রাহক অনুধাবন করেন লংকাবাংলা তার সুখ-দুঃখের ভাগীদার। কোনো ভালো গ্রাহক আর্থিক চাপের কারণে ইএমআই পরিশোধে অনিয়মিত হয়ে পড়লে আমরা পাওনা আদায়ে নিছক চাপ দেয়ার বদলে তার সুবিধা-অসুবিধাগুলো বুঝে সমস্যাটির একটি কাস্টমাইজড সমাধান বের করি।
পোর্টফোলিও রিস্কের কথা বলছিলাম…
ঝুঁকির দুটি দিক— ঋণগ্রহীতার ব্যক্তিত্ব আর তার ক্রেডিটওয়র্দিনেস। আমাদের টিম দুটোর ব্যাপারেই সিরিয়াস।
উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করলে একটি ঝুঁকির কথা আমি উল্লেখ করতে পারি। ধরুন অর্থনৈতিক কারণে কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণী-পেশার মানুষের আয়স্তর অস্বাভাবিক হারে নেমে গেল। তিনি, তারা চাইলেও ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কখনো ওই পরিস্থিতি এলে আমরা সংশ্লিষ্ট গ্রাহকদের সামর্থ্য পুনর্বিবেচনা করে ইএমআই পুনর্নির্ধারণ করব, যা উভয় পক্ষের জন্যই উইন-উইন হবে। দেশের ভোক্তাশ্রেণী এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সহসা এখানে কোনো চাপ আমি আশঙ্কা করছি না।
গত কয়েক বছরে আর্থিক সেবাদাতাদের কাছে রিটেইল লোন ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সম্ভাবনা কতদূর?
দেখুন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের এ পর্যায়ে আমরা একটি সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণী পেয়েছি, যারা প্রথমত মৌলিক চাহিদাগুলো যেনতেনভাবে পূরণ করার বদলে জীবনমান নিয়েও অত্যন্ত সচেতন। জনগোষ্ঠীর একটি অংশ প্রতি বছরই নতুন করে এ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হচ্ছে। সীমিত সাধ্যের মধ্যে তারা নিজেদের সাংস্কৃতিক জীবনমান উন্নয়নেও সচেষ্ট। বিভিন্ন রিটেইল লোন তাদের এ প্রচেষ্টায় সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
আমি দেখছি গ্রাহকদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন এসেছে। অর্থের সময়মূল্য সম্পর্কে সচেতন মানুষ আজকের ক্রয় আর ক্রয়ের মধ্যে পার্থক্যটি অনুধাবন করেন। এ কারণে তারা যৌক্তিক হারে সুদ পরিশোধেও প্রস্তুত। অন্যদিকে নিয়মিত বিল পরিশোধ করলে ক্রেডিট কার্ডের কেনাকাটায় কোনো সুদই দিতে হয় না। উল্টো অনেক ডিসকাউন্ট, সুদমুক্ত কিস্তির সুবিধা তো রয়েছেই।
ঋণদাতাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, করপোরেটদের দেয়া বড় বড় ঋণে অনেক ঝুঁকি রয়েছে। রিটেইলে চাহিদাটি পুরোপুরি সুপ্ত। সেবার ব্যপ্তি বাড়াতে পারলে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষও খুব ভালো গ্রাহক হতে পারেন। আমাদের কর্মীরা গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছতে না পারলেও অনেক সেবা রাজধানীর বাইরে প্রথমবারের মতো নিয়ে যাচ্ছে।
রেগুলেটরি দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন এসেছে। এক দশক আগেও আর্থিক খাতের তহবিল অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগানো বলতেই ধরে নেয়া হতো শিল্প-বাণিজ্য। রিটেইল লোনকে অনুত্পাদনশীল খাত হিসেবে নিরুত্সাহিত করা হতো। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতায় আমরা অনুধাবন করলাম, অর্থনীতির গতিশীলতায় ভোক্তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সুদের হারও অনেক কমে এসেছে। শিল্প-বাণিজ্যের তুলনায় কিছুটা বেশি হলেও এখন অনেক রিটেইল লোনের সুদ ১০ শতাংশের আশপাশে। আমি রিটেইল লোনের ভবিষ্যত্ সম্পর্কে অত্যন্ত আশাবাদী।
রিটেইলে আপনাদের প্রডাক্টগুলো সম্পর্কে জানাবেন?
নিশ্চয়ই। আমাদের ওয়েবসাইট ও হেল্পলাইনে প্রতিটি প্রডাক্ট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
আমি মোটা দাগে বিষয়গুলো বলছি। প্রথমেই বলব হোম লোনের কথা। হোম লোনে আমাদের পোর্টফোলিও সম্প্রতি হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা অনেক ব্যাংকেরও নেই। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, কস্ট অব ফান্ড ব্যাংকের চেয়ে বেশি হওয়া সত্ত্বেও আমরা কীভাবে এতটা এগোলাম। এনবিএফআই হিসেবে আমাদের হোম লোনের সুদও ব্যাংকের চেয়ে কিছুটা বেশি, প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ। তার পরও আমাদের প্রবৃদ্ধিই বেশি। প্রথমার্ধেই হোম লোনে আমাদের বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়ে গেছে। এটি প্রমাণ করে, গ্রাহকরা দু-এক পারসেন্টেজ পয়েন্ট সুদের চেয়ে তাদের প্রয়োজন ও আমাদের সেবার মানকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। কারণ আমরা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য দেশে প্রথমবারের মতো নতুন নতুন কাস্টমাইজড প্রডাক্ট নিয়ে আসছি। কিছু উদাহরণ দিতে পারি, বড় শহরের বাইরে ছোট ছোট ফ্ল্যাট বা প্লট কেনার জন্য স্কুল শিক্ষকরাও আমাদের কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাচ্ছেন। পেশাজীবীরা তাদের সমমনাদের নিয়ে একটি প্লট ক্রয় বা ভবন নির্মাণ করতে চাইলেও আমাদের সহযোগিতা নিচ্ছেন। বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কেনায় উচ্চবিত্তদের জন্যও আমাদের বিশেষ প্রডাক্ট রয়েছে।
অটো লোনের কথায় আসি। একটা নির্দিষ্ট সীমার উপরে স্থিতিশীল মাসিক আয়, এমন মানুষজন আমাদের কাছ থেকে সহজে গাড়ি কেনার জন্য ঋণ নিতে পারছেন। প্রথম তিন মাস আমরা তাদের কাছ থেকে কিস্তি আদায় করি না। ঝামেলামুক্ত ও আন্তরিক সেবা মধ্যবিত্তদের আমাদের অটো লোনে আকৃষ্ট করছে। জানুয়ারি-জুন সময়ে দেশে যে পরিমাণ অটো লোন বিতরণ হয়েছে, তার প্রায় ৪৫ শতাংশই আমরা দিয়েছি। বর্তমানে অটো লোনে আমাদের পোর্টফোলিও ৭২৫ কোটি টাকার, যা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ। এই ক্যাটাগরিতে আমরা এখন সীমিত পরিসরে মোটরসাইকেল লোনও দিচ্ছি। এখানে বরাদ্দ বাড়ানোর একটা চাপ অনুভব করছি।
আপনারা জানেন, আমরা দেশে প্রথম প্রজন্মের ক্রেডিট কার্ড ইস্যুয়ার। বর্তমানে ভিসা ও মাস্টারকার্ড এ দুই প্রতিষ্ঠানের কার্ড দেয়া হচ্ছে গ্রাহকদের। নামিদামি প্রায় সব রিটেইল ব্র্যান্ডের সঙ্গেই আমাদের ইএমআই-ডিসকাউন্ট চুক্তি রয়েছে। এখন চিকিত্সা, পর্যটন, ভ্রমণ এমন অনেক সেবার বিলও আমাদের ইএমআইয়ের আওতায় চলে এসেছে। এছাড়া ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে চেকেও অনেক বিল বা দেনা পরিশোধ করতে পারেন আমাদের গ্রাহকরা। প্রথমেই বলেছি, গ্রাহকের সুবিধাকে অগ্রাধিকার দেয়ার কারণেই আমাদের প্রডাক্টগুলোর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। গেল অর্ধবার্ষিকীতে দেশে ইস্যু হওয়া নতুন ক্রেডিট কার্ডের প্রায় এক-চতুর্থাংশই ছিল লংকাবাংলার।
ব্যক্তিগত যেকোনো প্রয়োজনে বেতন বা সম্পত্তির বিপরীতে আমাদের কাছ থেকে পারসোনাল লোন নিচ্ছেন অনেক মানুষ। সব শ্রেণীর গ্রাহকের সুবিধার্থে এখানেও আমরা অনেক কাস্টমাইজড প্রডাক্ট চালু করছি।
প্রডাক্ট কাস্টমাইজেশন আর আন্তরিক সেবা— এ দুটি বৈশিষ্ট্য আমাদের প্রতিটি সেকশনেই থাকবে।