আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
রডের বাজারে অস্থিরতা স্থবির নির্মাণ শিল্প

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীতে গত রোববার প্রতি টন ৬০ গ্রেড মানের রড বিক্রি হয় ৭১ হাজার টাকা থেকে ৭২ হাজার টাকা। এক সপ্তাহ আগের দর ছিল ৬২ হাজার থেকে ৬৫ হাজার টাকা। ছয় মাস আগে এ রড বিক্রি হয় ৪৭ থেকে ৪৮ হাজার টাকায়। উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ ছাড়াই রডের দাম বেড়েছে টনপ্রতি ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। এ দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা এবং মিলমালিকেরা ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছেন। ফলে বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। আর নির্মাণ শিল্পে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা।

রডের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধিতে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছে। নির্মাণসামগ্রীর বিক্রি নেমে এসেছে অর্ধেকে। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন নির্মাণ শিল্পে সংশ্লিষ্ট রিয়েল এস্টেট সেক্টরের নেতারা। নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। আর শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইর পক্ষ থেকে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে লিখিত বক্তব্য চাওয়া হয়েছে স্টিল মিলমালিকদের কাছে। তাদের দাবি, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং পরিবহন ও বন্দর খরচ বেড়ে যাওয়ায় রডের দাম বেড়েছে।

রডের বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে : বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ডিসেম্বর থেকে মার্চ-বছরের এই চার মাসেই রড বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এবার রডের বিক্রি কমে গেছে। মাসের ব্যবধানে রডের বিক্রি কমে অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। অস্বাভাবিক হারে মূল্য বাড়ায় বিক্রি কমেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। আর মিলমালিকেরা বলছেন, কাঁচামালের আমদানি খরচ, ডলারের মূল্য ও পরিবহন খরচ বাড়ায় রডের মূল্য বেড়েছে। তবে আয়রন অ্যান্ড স্টিল মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বলছে, মূল্য বাড়ার পেছনে মিলারদের সিন্ডিকেট আছে। এ সিন্ডিকেটই মূল্য বাড়িয়েছে। রাজধানীর ইংলিশ রোডে অবিস্থত আয়রন অ্যান্ড স্টিল মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সচিব মো: আবু তাহের বলেন, মূল্য বাড়লে বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। মূল্য বাড়ার কারণে এখন ছোট ব্যবসায়ীরা রড কিনতে সাহস পাচ্ছেন না। ফলে রডের বিক্রি অনেক কমে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, গত বছরও রডের মূল্য বেড়েছিল। হঠাৎ বাড়া আবার কমার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানকে লোকসান গুনতে হয়েছিল। এক বছর আগে আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের আওতায় প্রায় ৪০০ প্রতিষ্ঠান ছিল। তার মধ্যে ১২৫টি ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।

ক্ষতিগ্রস্ত ৭০ লাখ মানুষ
আবাসন খাতের অন্যতম উপকরণ রড সিমেন্টসহ অন্যান্য সামগ্রীর দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ায় এ খাতের প্রায় ৭০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে দাবি করেছেন নির্মাণ খাতের উদ্যোক্তাদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) নেতারা। তাদের দাবি, অসাধু ব্যবসায়ীদের একটি চক্র যোগসাজশ করে রডের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বিএসিআইয়ের সভাপতি মুনীর উদ্দিন আহমেদ অভিযোগ করে বলেন, ২৭ মার্চ সকালে টন প্রতি এমএস রডের দাম ছিল ৬৩ হাজার টাকা আর ওই দিন বিকেলে টনপ্রতি রডের দাম দাঁড়ায় ৭২ হাজার টাকা। এতেই প্রমাণ হয়, একটি চক্র সিন্ডিকেটের মাধ্যমে রডের দাম বাড়াচ্ছে। এক সংবাদ সম্মেলনে রডের দর বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরে এ প্রকৌশলী বলেন, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে টনপ্রতি রডের দর ছিল ৪৮ হাজার থেকে ৫০ হাজার। কিন্তু এ কয় মাসে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে রডের মূল্য। আমরা সাধারণত ৫ শতাংশ লাভ করে থাকি। কিন্তু রডের মূল্য বৃদ্ধিতে ২৫ শতাংশ লোকসান হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ব্যবসায় গুটিয়ে নিতে হবে।

নির্মাণকাজ বন্ধের হুমকি
বিএসিআইয়ের নির্বাহী সদস্য ইঞ্জিনিয়ার শফিকুল হক তালুকদার বলেন, বাংলাদেশের এমএস রড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এককভাবে কোনো নিয়মনীতি না মেনে অস্বাভাবিক এবং অব্যাহতভাবে রডের দর বাড়িয়ে চলেছে। তারা বলে থাকেন, কাঁচামালের দাম, পরিবহন খরচ, ডলারের দাম, ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি এবং চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে বিলম্বের কারণে রডের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব কারণে রডের দাম সর্বোচ্চ ৭ থেকে ৮ শতাংশ বাড়তে পারে; কোনো অবস্থাতেই ৫০ শতাংশ বাড়তে পারে না। এ পেশার সাথে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ জড়িত জানিয়ে শফিকুল বলেন, নির্মাণসামগ্রীর দর বাড়ার ফলে নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে প্রচুর জনবল কর্মহীন হবে। এ ছাড়া পরোক্ষভাবে আরো ৩০ লাখ এ শিল্পের সাথে জড়িত বলে তিনি জানান। তার অভিযোগ, রড সিন্ডিকেটের দেখাদেখি সিমেন্ট কোম্পানিগুলো গত ২৫ দিনে ব্যাগপ্রতি ৬০ টাকা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া টাইলস, ইলেকট্রিক ক্যাবল, স্যানিটারি মালামাল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি, সরকার অতি দ্রুত পিপিআর অনুযায়ী আমাদের প্রাইস অ্যাডজাস্ট ক্লজ-২৭.৯ কার্যকর করবেন। না হলে আমরা ১৫ এপ্রিল থেকে সব নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবো।

চার প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্দী
এ দিকে দেশের চার প্রতিষ্ঠানের কাছে রড ব্যবসায় বন্দী বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি রডের যে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি, এর পেছনেও ওই চার প্রতিষ্ঠানের হাত রয়েছে। এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো বিএসআরএম স্টিল লিমিটেড, রহিম স্টিল, বন্দর স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং আবুল খায়ের স্টিল মিলস লিমিটেড। এ চার প্রতিষ্ঠানের ওপর রডের মূল্য ওঠানামা নির্ভর করে। বিভিন্ন পর্যায়ের রড ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশে রডের বাজারের প্রায় ৩০ শতাংশই বিএসআরএমের দখলে। রহিম স্টিল (আরএসএম), বন্দর স্টিল এবং আবুল খায়ের স্টিল লিমিটেডের দখলে রয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ বাজার। এ ছাড়া রডের যে কেমিক্যাল আমদানি হয় তার প্রায় ৮০ শতাংশই আনে রহিম স্টিল। ব্যবসায়ীরা জানান, ওই চার প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কবির স্টিল (কেএসআরএম), রতনপুর রি-রোলিং মিলস (আরএসআরএম), আনোয়ার ইস্পাত, শফিউল আলম স্টিল, শাহরিয়ার স্টিল মিলসও রডের বড় একটি অংশ জোগান দেয়। তবে রডের মূল্য ওঠানামার পেছনে এসব প্রতিষ্ঠানের খুব একটা ভূমিকা থাকে না। মূলত রডের মূল্য বাড়বে, নাকি কমবে তা নির্ভর করে বিএসআরএমের ওপর।

ফ্ল্যাট হস্তান্তরে অনিশ্চয়তা
রড-সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ফ্ল্যাটের দাম বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। আর এতে যথাসময়ে ফ্ল্যাট হস্তান্তর অনিশ্চয়তার মুখে পড়ার আশঙ্কা করছে সংস্থাটি। নির্মাণসামগ্রীর দামের সাম্প্রতিক ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রিহ্যাবের পক্ষ থেকে এমন দাবি করা হয়। এ সময় রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন জানান, সম্প্রতি নির্মাণ খাতের প্রধান তিনটি উপকরণ রড, সিমেন্ট ও পাথরের দাম আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে, পিছিয়ে নেই ইটের দামও। এর মধ্যে রডের দাম বেড়েছে প্রায় 35 শতাংশ, সিমেন্টের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ এবং প্রতি ইটে ১ টাকা বেড়েছে। নির্মাণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা বেকায়দায় পড়েছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ২০০ টাকার মতো বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করেন তারা। আবার ফ্ল্যাটের মোট মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ নিবন্ধন ব্যয় থাকায় তা ক্রেতাদের ওপর চাপ বাড়াবে। রিহ্যাব সভাপতি বলেন, দীর্ঘ মন্দা কাটিয়ে আবাসন খাত যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, সেই মুহূর্তে উপকরণের দাম বৃদ্ধিতে নির্মাণকাজ গতিহীন হয়ে পড়বে। নির্মাণখরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই এরই মধ্যে সাময়িকভাবে কাজ বন্ধ করে দিতে চাচ্ছেন। আর যথাসময়ে ফ্ল্যাট হস্তান্তর অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে। এতে দুর্ভোগে পড়বেন চুক্তিবদ্ধ ক্রেতারা।

কারণ জানতে চায় এফবিসিসিআই
কয়েক মাসের ব্যবধানে টনপ্রতি রডের মূল্য ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বৃদ্ধির কারণ রড ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চেয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। গত সপ্তাহে রাজধানীর মতিঝিল ফেডারেশন ভবনে এক মতবিনিময় সভায় এ বিষয়ে জানতে চান এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো: শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। আসন্ন ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট উপলক্ষে রাজস্ব নীতিমালা, আমদানি শুল্ক, মূল্যসংযোজন কর (মূসক) ও আয়কর এবং মাঠপর্যায়ে মূসক ও করসম্পর্কিত নানাবিধ সমস্যা নিয়ে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি বলেন, আপনাদের কত টাকা উৎপাদন খরচ বেড়েছে। আর বাজারে দাম বাড়িয়েছেন কত। দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা কতটুকু বলেন। এটার সাথে ব্যবসায়ীদের ভাব জড়িত। এ সময় রডব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি মেট্রোসেম সিমেন্ট কোম্পানির এমডি মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেন, দাম বাড়ার পেছনে তিন-চারটি কারণ রয়েছে, তার অন্যতম হচ্ছে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে কাঁচামালের ওপর কর বাড়িয়েছে। আগে যেখানে আমদানি খরচ ৩০০ ডলার লাগত। এখন সেখানে লাগে ৪৩০ ডলার। এ ছাড়া বন্দর ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। এফবিসিসিআই সভাপতি রড ব্যবসায়ীদের দাম বাড়ার যৌক্তিক কারণ লিখিত আকারে জানাতে বলেন।