রাজধানী শহর ঢাকার জনসংখ্যা বেড়ে চলছে দ্রুত। আজ তা দুই কোটির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আজ জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ রাজধানীবসীর আবাসন চাহিদা মেটাতে গড়ে উঠেছে কাঁচা অনিরাপদ ঘরবাড়ি। আশপাশে নিচু জমি বা সম্পূর্ণ জলাভূমি ভরাট করে নির্মিত হচ্ছে অসংখ্য বহুতলবিশিষ্ট ভবন। এসবের অধিকাংশের নির্মাণ নকশা বা ডিজাইনে রাজউকের অনুমোদন নেই। আবার অনুমোদন নিয়েও সে অনুযায়ী ভবন নির্মাণকালে তা অনুসরণ করা হয় না। নির্মাণ শ্রমিক এবং ভবন মালিক নিজের পছন্দমতো বাড়ি বানিয়ে ফেলেন। কখনও দোতলা বা তিনতলা ভবনের অনুমোদন নিয়ে নির্মিত হয় ৭-৮ তলা ভবন। এ ক্ষেত্রে নেওয়া হয় না বিশেষ কোনো প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। বিল্ডিং কোড না মেনে এবং ভূকম্পন প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াই অহরহ তৈরি করা হয় বহুতল ভবন। সাম্প্রতিককালে খাল-বিল, নদী-নালাসহ নিচু জমি ভরাট করে কোনো রকম মাটি দৃঢ়করণ ছাড়াই নির্মিত হচ্ছে বহুতলবিশিষ্ট বাড়ি, নগর অবকাঠামো। অনেক ক্ষেত্রেই পাইলিং বা অন্য কোনো ধরনের বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না নিয়ে গড়ে উঠছে বড় বড় আবাসিক ভবন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে হাজার হাজার মানুষ বসবাস করছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোয় নির্বিঘ্নে চলছে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, নির্মাণাধীন ভবনের মাটি পরীক্ষা, পাইল ডিজাইন ও নির্মাণ ত্রুটিজনিত কারণে প্রায়ই ভবন ধসের ঘটনা ঘটছে। রাজউক এসব নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ফলে প্রায়ই ভবন হেলে বা ধসে পড়ার ঘটনা ঘটছে। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার মধ্যে যে বাংলাদেশের নাম রয়েছে, এর লক্ষণও মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে। ভূমিকম্প প্রতিরোধ এবং ভূমিকম্পের পূূর্বাভাস দেওয়ার মতো বৈজ্ঞানিক কোনো সংকেত দেওয়া অদ্যাবধি আবিস্কৃত হয়নি। তাই ভূমিকম্প বা যে কোনো কারণে ভবন ধস এড়াতে নিরাপদ বাসযোগ্য বাড়িঘর নির্মাণের বিকল্প নেই। দেশজুড়ে ভবন মালিকদের বাড়িঘর নির্মাণে নগর পরিকল্পনাবিদদের ডিজাইনে বিল্ডিং কোড মেনে ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নির্মাণের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। রাজধানী ঢাকার, বিশেষ করে পুরান ঢাকার হাজার হাজার ভবন রাতারাতি ভেঙে ফেলাও বাস্তবসম্মত নয় বিধায় সেগুলোকে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী রেট্রোফিট টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে বাসযোগ্য করে তোলা যায়। ভবন ভেঙে ফেলার চেয়ে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কম ব্যয়ে ভবনকে ভূমিকম্প সহনীয় করে তোলা সম্ভব। ইতিমধ্যে রেট্রোফিটিং করা ঢাকার তেজগাঁওয়ের ফায়ার সার্ভিস ভবন রেট্রোফিটিং করা হয়েছে।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ ভবনকে ভূমিকম্প সহনীয় করে তুলতে বিশেষজ্ঞ দল সমন্বয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি রেট্রোফিটিং সেলও গঠন করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে ভবন মালিকসহ নির্মাণের সঙ্গে জড়িত সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। পরিকল্পিত নিরাপদ নগরায়নের লক্ষ্যে সারাদেশে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার আবাসন উপযুক্ত জমি চিহ্নিত করে কৃষিযোগ্য জমি রক্ষা, জলাধার ও বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল সংরক্ষণ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। পুরান ঢাকার অতিরিক্ত দুর্বল, ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস অযোগ্য ভবনগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে ভেঙে ফেলা প্রয়োজন। পাশাপাশি ভবন ধসের পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় উদ্ধার তৎপরতা চালানোর লক্ষ্যে রাস্তাঘাটের ব্যাপক সংস্কার ও উন্নয়ন জোরদার করা প্রয়োজন। ভবন ধসের মতো দুর্যোগ মোকাবেলায় ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষিত করে তোলা জরুরি। ভেঙে পড়া ভবনের স্তূপ সরানো এবং উদ্ধারকাজ ত্বরান্বিত করতে অনতিবিলম্বে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা আবশ্যক। এ ব্যাপারে জনবল কাঠামো বাড়িয়ে এবং অন্যান্য সহযোগিতা দিয়ে রাজউক ও সংশ্নিষ্ট সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। নগর পরিকল্পনা, ভবন নির্মাণে যথেষ্ট সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের গুরুত্ব ভাবতে হবে এখনই।