আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
বাড়িভাড়ায় নাভিশ্বাস, ফের বাড়ানোর পাঁয়তারা

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মোরশেদ আলম। রুটি-রুজির তাগিদে প্রায় দেড় দশক আগে ঢাকায় আসেন। কয়েক বছর আগে বিয়ে করেছেন তিনি। স্ত্রী ও সন্তানকে ঢাকায় আনার পরই বাড়িভাড়া নিয়ে পড়েন বিপাকে। সাধ্যের মধ্যে পরিবার নিয়ে থাকার বাসা মিলছিল না। পরে এক বন্ধুর সঙ্গে ভাগাভাগির ভিত্তিতে ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। এখন দুই বন্ধু মিলে রাজধানীর রামপুরায় বসবাস করছেন।

ভাড়া ফ্ল্যাটে ভাগাভাগি করে থাকলেও শুধু চাকরির বেতনে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। টিকে থাকতে চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন কাজ করতে হচ্ছে তাকে।

মোরশেদ জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকায় বসবাসের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তদের জন্য বাড়িভাড়া অনেকটা বিষফোঁড়ার মতো। শুরুতে যে বেতন পেতাম তা দিয়ে মেসে কোনোমতে থাকতে পারতাম। কয়েক বছর হলো বিয়ে করেছি। এখন একটা সন্তানও আছে আমাদের। মধ্যমমানের একটি বাসা নিতেই সব চার্জসহ ১৬ হাজার টাকা লাগে। মাস শেষে ভাড়া পরিশোধে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। তবু রুটি-রুজির তাগিদে থাকতে হচ্ছে ঢাকায়।

তিনি আরও বলেন, ‘টিকে থাকতে চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন কাজ করছি। কখনো রাইড শেয়ারিং, অনলাইন পণ্য ডেলিভারির কাজও করি। স্ত্রী-সন্তানকে অতিরিক্ত কাজের বিষয়টি বুঝতেও দিই না।’

jagonews24

মোরশেদ বলেন, ‘বাড়িভাড়া দিতেই বেতনের বেশিরভাগ অংশ চলে যায়। ছয় মাস গেলেই বাড়িভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা করেন মালিক। নামে-বেনামে বিভিন্ন সার্ভিস চার্জ বাড়িয়ে দেন। মানসিক যন্ত্রণায় দিন পার করতে হচ্ছে।’

পরিসংখ্যান মতে, রাজধানীতে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। এর মধ্য়ে ৮০-৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকে। মোরশেদ আলমের মতো বেসরকারি চাকরি কিংবা ছোটখাটো ব্যবসা করে ঢাকায় টিকে থাকার লড়াই করা মানুষের সংখ্যা লাখ লাখ। নিম্ন আয়ের মানুষ মাস শেষে বাড়িভাড়া গুনতেই হিমশিম খান। বাড়িভাড়া দিতে না পেরে একসময় গ্রামে ফিরে যেতে হয় তাদের। আবার কখনো কখনো ঘরের জিনিস আটকে রেখেও বাড়িভাড়া আদায় করেন মালিক। কখনো নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে।

এমন সঙ্কটের কারণেই করোনাকালে মধ্য়বিত্ত-নিম্নবিত্ত অনেকের চাকরি চলে যাওয়া কিংবা ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্রামে চলে গেছেন লাখ লাখ মানুষ। এখনো তারা ফিরতে পারেননি। যারা আছেন তারাও বেঁচে থাকার লড়াইয়ে দিনাতিপাত করছেন।

ভাড়াটিয়াদের অভিযোগ, করোনা শেষ না হলেও বাড়িওয়ালারা নতুন বছর থেকে বাড়িভাড়া বাড়ানো হবে বলে তাদের জানিয়েছেন। ভাড়াটিয়াদের কল্যাণে কাজ করা সংগঠন ‘ভাড়াটিয়া পরিষদ’ বলছে, তারা শুনেছেন নতুন বছর থেকে বাড়িভাড়া বাড়ানোর চিন্তা করছেন মালিকরা। সে জন্য তারা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

jagonews24

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সেলিম হোসেন (ছদ্মনাম)। করোনা পরিস্থিতিতে হুট করে অফিস থেকে বেতন কমিয়ে দেয়ার কথা জানানো হয় তাকে। কিন্তু ঢাকায় অবস্থান করেই কাজ করতে হবে তাকে। করোনা শুরু হওয়ার আগেই তিনি বিয়ে করেছিলেন। বেতন অনুপাতে বাসাও ভাড়া নিয়েছেন।

তিনি বলেন, ঢাকায় বাড়িভাড়া নিয়ে বাড়িওয়ালাদের সিদ্ধান্তই শেষ কথা। প্রয়োজনের তাগিদে আমাদের থাকতে হয়। বাড়িভাড়ার বিষয়টি সরকার কিংবা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তদারকি করা হলে হয়তো বিড়ম্বনা কিছুটা কমবে।

হাতিরঝিল এলাকায় চারজন মিলে দুই রুমের একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। সবাই ব্য়াচেলর। তাদের একজন ফারুক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মাস শেষে যে বেতন পান বাড়িভাড়া দিতেই অর্ধেক শেষ হয়ে যায়। কথায় কথায় তিনি বলেন, ঢাকায় তো বাড়িভাড়া গুনতেই আমাদের সব শেষ হয়ে যায়। বাড়িভাড়া পরিশোধের পর হাতে যে টাকা থাকে, তা দিয়ে মাসের খাওয়াও হয় না ঠিকমতো। মাস শেষ হওয়ার আগেই টাকা ধার করতে হয়।

তিনি বলেন, বাড়িভাড়া নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। যেন বাড়িওয়ালারা ইচ্ছামতো ভাড়া নিতে না পারেন। বাড়িভাড়ার বিড়ম্বনা নিয়ে লাখ লাখ মানুষ ভোগান্তি পোহাচ্ছে। অথচ সমাধানের বিষয়ে সরকার কিংবা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ে না।

ভাড়াটিয়ারা জানান, প্রতি বছরের শুরুতেই বাড়িওয়ালারা ভাড়া বাড়ানোর চেষ্টা করেন। অনেক বাড়িওয়ালা জানুয়ারি থেকে ভাড়া বাড়ানো হবে বলেও জানিয়েছেন। কিন্তু ১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, দুই বছরের আগে ভাড়া বাড়ানো যায় না। আবার জামানতও নেয়া যাবে না। এ জন্য ভাড়াটিয়া ও বাড়ির মালিকপক্ষকে চুক্তিবদ্ধ হতে হয়। কিন্তু এসবের কোনোকিছুই মানা হয় না।

jagonews24

ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার জাগো নিউজকে বলেন, বাড়িভাড়া নিয়ে ভাড়াটিয়াদের ভোগান্তির শেষ নেই। করোনাকালের শুরু থেকেই বাড়ি ভাড়া মওকুফসহ বেশকিছু দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু এসবের কোনোটাই মানা হয়নি। করোনার মাঝে ভাড়াটিয়াদের অনেকেরই চাকরি চলে যাওয়ায় গ্রামে চলে গেছে। যারা থাকার চেষ্টা করছেন, তারাও কষ্টে আছেন।

তিনি আরও বলেন, আমরা জানতে পেরেছি যে, নতুন বছরে ভাড়া বাড়ানো হবে। কিন্তু কেন? যেখানে করোনার বিরূপ প্রভাব থেকে আমরা এখনো বের হতে পারিনি, সেখানে বাড়িভাড়া বাড়ানো কোনোভাবেই যৌক্তিক হবে না।

বাহারানে সুলতান আরও বলেন, আমরা গতকাল বৈঠক করেছি। ২২ ডিসেম্বর প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছি। সিদ্ধান্ত হয়েছে, কোনোভাবেই বাড়িভাড়া বাড়াতে দেয়া হবে না। এ জন্য সিটি করপোরেশনের কাছে আমাদের দাবি জানাব।

তিনি বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য বাড়িভাড়া আইন সংশোধনের মাধ্য়মে যুগোপযোগী করে সঠিকভাবে প্রয়োগের দাবি জানান। জাগোনিউজ২৪