আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
গৃহায়ণের প্লট পেতে ৩৬ বছরের অপেক্ষা

১৯৮৪ সালে প্লটের জন্য আবেদন করেছিলেন আনোয়ারুল ইসলাম। পরের বছরই গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ তাঁকে পৌনে দুই কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ দেয়। কিন্তু তিন যুগ ধরে তাঁর প্লট অবৈধ দখলদারের দখলে। দখলদার উচ্ছেদ করে তাঁকে এখনো প্লট বুঝিয়ে দিতে পারেনি গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ।

প্লট বুঝে পেতে নানাভাবে চেষ্টা করেছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম। গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের দপ্তরে দপ্তরে ঘুরেছেন। অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে দফায় দফায় প্রতিশ্রুতিও পেয়েছিলেন তিনি। অন্তত চারবার অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের জন্য তারিখও নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু দখলদার উচ্ছেদ হয়নি।

কেবল আনোয়ারুল ইসলাম নন, প্লট বুঝে না পাননি আরও ৩৯ জন। নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায়, রাজধানীর মিরপুর-৫ নম্বর সেকশনের সম্প্রসারিত রূপনগর আবাসিক এলাকায় ১৯৮৪ সালে প্লট বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তি দেয় তৎকালীন গৃহসংস্থান অধিদপ্তর (বর্তমান জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ)। এরপর ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে ৭৪ জনকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্য থেকে ৩৪ জন প্লট বুঝে পেয়েছেন।

প্লট বুঝে না পাওয়া ৪০ জনের মধ্যে ১৪ জন গঠন করেছেন রূপনগর প্লট মালিক সমিতি। তাঁদের মধ্যে ৭ জন প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন ১৯৮৫ সালে। সমিতির সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত চারটি উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু অজানা কারণে তা থেমে যায়।

আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি চিন্তাও করতে পারেননি যে তাঁর প্লট আরেকজন দখল করে রাখবে। তিনি বলেন, প্লট বুঝে না পাওয়ায় ঢাকা ছেড়ে তাঁকে থাকতে হচ্ছে প্রায় আড়াই শ কিলোমিটার দূরের সিলেট শহরের বাড়িতে।বিজ্ঞাপন

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৭ সালের জুলাইয়ে প্রথমবার উচ্ছেদ অভিযানের উদ্যোগ নেয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। তারিখ নির্ধারণ করা হয়, পরের বছরের ১ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু ‘অনিবার্য কারণে’ এক সপ্তাহ আগে অভিযান স্থগিত হয়ে যায়। ২০১৮ সালের ১৯ এপ্রিল উচ্ছেদের জন্য দ্বিতীয় দফায় তারিখ ঠিক করা হয়। তবে ম্যাজিস্ট্রেটের বদলির কারণে অভিযান চালানো যায়নি। এরপর প্লটগুলোর অবৈধ দখলদার প্রসঙ্গে সরেজমিন তদন্ত করে যৌথ প্রতিবেদন দিতে ২০১৯ সালের এপ্রিলে ঢাকা ডিভিশন-১ ও মিরপুর হাউজিং এস্টেটের প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে চিঠি দেন গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ভূমি ও সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা শাখার উপপরিচালক। এই নির্দেশনার সাত মাস পর দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, প্লট বুঝিয়ে দিতে না পারায় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

এরপর ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর উচ্ছেদের জন্য ব্যবস্থা নিতে ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দেন গৃহায়ণের প্রশাসন ও অর্থ শাখার পরিচালক। এরপর তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ উল্ল্যাহ ২৯ ডিসেম্বর তৃতীয় দফায় উচ্ছেদ অভিযানের তারিখ নির্ধারণ করেন। তবে পরের বছরের ১৩ জানুয়ারি কর্তৃপক্ষ জানায়, অনিবার্য কারণে উচ্ছেদ অভিযান হয়নি। চতুর্থবারের মতো ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি উচ্ছেদ অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়। ১০ প্লাটুন পুলিশ সদস্যও নিয়োগ করা হয়। কিন্তু সে সময় রূপনগর থানা-পুলিশের এক প্রতিবদনে শঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, ঢাকা উত্তর সিটির উপনির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা অবনতি হতে পারে। এ কারণে উচ্ছেদের ওই পরিকল্পনাও ভেস্তে যায়।

আমার স্বপ্ন, মৃত্যুর আগে তিন সন্তানের জন্য ঢাকার ভেতরে স্থায়ী ঠিকানা রেখে যাব। কিন্তু স্বপ্নটা আদৌ পূরণ করতে পারব কি না, জানি না।

লুৎফর রহমান, প্লট মালিক

সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, প্লটগুলোতে অবৈধভাবে ঘর বানিয়ে বসবাস করছেন লোকজন। কোনো ঘর টিনশেডের আবার কোনোটি সেমিপাকা। সেখানে তৈরি করা হয়েছে দোতলা ঘরও। অনেকে ঘর বানিয়ে নিজেরা থাকছেন, আবার অনেকে ভাড়া দিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কথা বলতে রাজি হননি কোনো দখলদার।

প্লট বুঝে না পাওয়াদের একজন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্ন, মৃত্যুর আগে তিন সন্তানের জন্য ঢাকার ভেতরে স্থায়ী ঠিকানা রেখে যাব। কিন্তু স্বপ্নটা আদৌ পূরণ করতে পারব কি না, জানি না।’ তিনি জানান, প্লটের দাম ছিল দুই লাখ টাকা। আবেদন করার সময় ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। বাকি টাকা দিয়েছেন চার কিস্তিতে।
প্লট বুঝে পেতে মরিয়া প্লট মালিকেরা সম্প্রতি উচ্ছেদের যাবতীয় খরচ বহনের আগ্রহ প্রকাশ করে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের বরাবর আবেদন করেছেন। সমিতির নেতারা বলেন, প্রয়োজনে সব খরচ তাঁরা দেবেন। তা–ও যেন কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদের ব্যবস্থা করে।

কেন এত দিন প্লটগুলো বুঝিয়ে দেওয়া যায়নি—এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ঢাকা ডিভিশন-১–এর নির্বাহী প্রকৌশলী জোয়ারদার তাবেদুন নবী প্রথম আলোকে বলেন, নানা আইনি জটিলতায় বারবার উচ্ছেদের পদক্ষেপ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, শিগগিরই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যৌথ অভিযান চালিয়ে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করা হবে। এরপরই মালিকদের প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হবে। গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের খরচেই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা। প্রথম আলো