আবাসন খাতে ব্যাংক ঋণের সুদহার বেশি হওয়ায় এক সময় অনেকেই আগ্রহ দেখাননি। তবে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট বা এক অঙ্কের ঘরে আসার পরই বেড়েছে ঋণের চাহিদা। বেড়েছে ফ্ল্যাট ক্রেতার সংখ্যাও। ফলে চলতি বছর করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও ফ্ল্যাট বিক্রির রেকর্ড হয়েছে। চাহিদা বিবেচনায় ব্যাংকগুলো এবার হাজির হয়েছে রাজধানীতে অনুষ্ঠিতব্য আবাসন মেলায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পছন্দের ফ্ল্যাট থাকলেও অনেকেই অর্থাভাবে তা কিনতে পারেন না। তাদের পছন্দের ফ্ল্যাট কেনার সঙ্গী হতে এবার মেলায় হাজির হয়েছে ব্যাংক ও কিছু আর্থিকপ্রতিষ্ঠান। তারা দিচ্ছে কম সময়ে স্বল্প সুদে ঋণ। তাদের ৭ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ। কোনো গ্রাহক ফ্ল্যাট কেনায় লোন সুবিধা নিতে চাইছে তা স্বল্প সময়ের মধ্যেই পাবেন।
আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, চলতি বছর ফ্ল্যাট বিক্রি বেড়েছে ১২ শতাংশ। করোনার বছরেই প্রথমবারের মতো দেশে ফ্ল্যাট বিক্রি ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। এর আগে প্রতি বছরে সাড়ে ৮-৯ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি হতো। তবে এ বছর তা ১০ হাজারের মাইলফলক স্পর্শ করেছে।
এদিকে, করোনার পর সবকিছু ঘুরে দাঁড়ালে ব্যাংকগুলোও গৃহঋণে এগিয়ে আসে। ফলে গৃহঋণের প্রবৃদ্ধি প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবমতে, চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো থেকে গৃহঋণের প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৭ শতাংশ, যেখানে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১০ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যাংক থেকে সিঙ্গেল ডিজিটের সুদহারে ঋণ পাওয়ায় আবাসন খাতের ঋণচাহিদা বেড়েছে। এক বছরে আবাসন কোম্পানিগুলোর ঋণের পরিমাণ দুই হাজার ৬২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২৫ হাজার ১৩২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এই খাতে ২০১৯ সালে ঋণের পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ৭০ কোটি টাকা।
২০২০ সাল শেষে আবাসন খাতে ব্যক্তিশ্রেণির ঋণ ৭৫৫ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজার ৭০১ কোটি টাকা, যা বেড়েছে ২ দশমিক ২২ শতাংশ। এক বছর আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালে যা ছিল ৩৩ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ব্যক্তিপর্যায়ের ঋণস্থিতির মধ্যে শহরে ২৫ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা ছিল আবাসন ঋণ। গ্রামে ছিল দুই হাজার ২২৬ কোটি টাকা। তাছাড়া ফ্ল্যাট-বাড়ি সংস্কারে ছয় হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা ঋণ দেয় ব্যাংকগুলো।
আবাসন খাতে ঋণ দিতে এবারের মেলায় অংশ নিয়েছে স্টান্ডার্ড চার্টার্ড, আইএফআইসি, ডাচ-বাংলা, প্রাইম, দ্য সিটি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। রয়েছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানও। তার মধ্যে রয়েছে ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং, আইপিডিসি, আইডিএলসি, ন্যাশনাল হাউজিং, লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্সসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সাড়ে ৭ থেকে সাড়ে ৮ শতাংশ সুদহারে গৃহঋণ দিতে হাজির হয়েছে এবারের মেলায়।
আবাসন মেলায় গৃহঋণের সুবিধা নিয়ে হাজির হয়েছে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনও। এখান থেকে ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট এবং বাড়ি নির্মাণ করতে পারবেন সরকারি চাকরিজীবীরা। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেট্টোপলিটন এলাকায় ৮-৯ শতাংশ সুদহারে ঋণ দিচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি। ঋণের বিপরীতে সুদের হার কমায় হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স থেকে ঋণের চাহিদা বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। এতে ফ্ল্যাট বিক্রি বেড়েছে বলে জানায় আবাসনখাত সংশ্লিষ্টরা।
আইএফসি ব্যাংক নতুন ঋণগ্রহীতার জন্য প্রসেসিং ফিতে ৫০ শতাংশ ছাড় নিয়ে হাজির হয়েছে। দ্রুত সময়ে ঋণ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। এ ব্যাংক থেকে আবাসনের জন্য ৫ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন গ্রাহক। দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত ওভারড্রাফট ঋণ সুবিধাসহ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ সুবিধা পাবেন।
ব্যাংক এশিয়া এক থেকে ২৫ বছর মেয়াদি ঋণ নিয়ে হাজির হয়েছে। সেখান থেকে একজন গ্রাহক পাঁচ লাখ থেকে সর্বোচ্চ দুই কোটি টাকা পর্যন্ত লোন নিতে পারবেন। একই ধরনের সুবিধা নিয়ে এসেছে ব্র্যাক ব্যাংক। গৃহঋণের সুবিধা নিয়ে হাজির হয়েছে সিটি ব্যাংক। ২২-৬৫ বছর বয়সি নাগরিকরা লোনের জন্য আবেদন করতে পারবেন। সহজে এবং কম সময়ে লোনের সুবিধা পাবেন এসব গ্রাহক।
নানা সুবিধা নিয়ে এসেছে ব্যাংক বর্হিভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। মেলা উপলক্ষে লঙ্কাবাংলা ফাইনান্স নিয়ে এসেছে ৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ সুদহারে হোম লোনের ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে কম সময়ের মমধ্যেই গ্রাহক এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে লোন নিতে পারছেন।
মাসিক কিস্তিতে সর্বোচ্চ ২৫ বছরের জন্য লোন নিতে পারবেন আইডিএলসি থেকে। মেলায় তাদের স্টল থেকে আরও অন্যান্য লোনের জন্যও কথা বলার সুযোগ রয়েছে। যে কোনো মূল্যের ফ্ল্যাট ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত লোন সুবিধা নিয়ে এসেছে আইপিডিসি।
লঙ্কাবাংলার সিনিয়র অফিসার মো. মুখলেচুর রহমান জাগোনিউজকে বলেন, মেলা উপলক্ষে আমাদের এখানে কীভাবে সহজে ও দ্রুত সময়ে লোন পাবেন, সে বিষয়ে আমরা পরামর্শ দিচ্ছি। আমাদের এখানে মাত্র ৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ সুদহারে গৃহঋণের ব্যবস্থা রয়েছে। আবার প্রসেসিং ফিতেও রয়েছে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়।
মেলা নিয়ে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব সহ-সভাপতি (প্রথম) কামাল মাহমুদ জাগোনিউজকে বলেন, ‘ব্যাংক লোনের সুদহার কমায় করোনার মধ্যেও আবাসন ব্যবসা ইতিবাচক ধারায় ছিল। আগামীতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে প্রত্যাশা করছি।’
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত মেলায় রয়েছে ২২০টি স্টল। প্রায় ১৫০টি আবাসন প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে। এতে ১৫টি নির্মাণসামগ্রী এবং ৩০টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। মেলা চলবে আগামী ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
মেলার সিঙ্গেল এন্ট্রির প্রবেশ ফি ৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। মাল্টিপল এন্ট্রির প্রবেশ ফি ১০০ টাকা। সিঙ্গেল এন্ট্রি টিকিটে একবার ও মাল্টিপল এন্ট্রি টিকিটে পাঁচবার মেলায় প্রবেশ করা যাচ্ছে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ক্রেতা দর্শনার্থীরা মেলায় প্রবেশ করতে পারছেন। মেলা উপলক্ষে এন্ট্রি টিকিটের ওপর র্যাফেল ড্রতে থাকছে আকর্ষণীয় পুরস্কার।
২০০১ সাল থেকে ঢাকায় রিহ্যাব হাউজিং ফেয়ার শুরু হয়। এছাড়া চট্টগ্রামে ১৪টি মেলা সফলভাবে সম্পন্ন করেছে রিহ্যাব। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৪ সাল থেকে বিদেশে হাউজিং ফেয়ার আয়োজন করে আসছে। এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ১২টি, যুক্তরাজ্য, দুবাই, ইতালির রোম, কানাডা, সিডনি, কাতারের একটি করে এবং দুবাইতে দুটি রিহ্যাব হাউজিং ফেয়ার সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।