# যৌক্তিক সমাধান এনেছে রিহ্যাব
# প্রকল্পে ১০ শতাংশের বেশি খরচে সমঝোতায় দরদাম
ঢাকার মিরপুরের শেওড়াপাড়া এলাকায় দীর্ঘদিন বসবাস করছেন আহমেদ। স্ত্রী ব্যাংকার। এই দম্পত্তির দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ব্যস্ত নগরে নিজের একটি আবাসন। এ নিয়ে দুজনের জমানো টাকা আর ব্যাংক লোনের মাধ্যমে চলমান একটি আবাসন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। ডাউন পেমেন্টের ৫০ লাখ টাকার সঙ্গে আরও ২৪ কিস্তিতে বাকি টাকা পরিশোধ করার কথা। মোট ১২শ স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাটের দাম নির্ধারণ হয় এক কোটি ২০ লাখ টাকা। যথাসময়ে কিস্তির টাকা পরিশোধ হলেও প্রকল্প শেষ হতে সময় লাগে অতিরিক্ত এক বছর।
এরই মধ্যে কয়েক ধাপে দাম বেড়ে যায় নির্মাণসামগ্রীর। রেকর্ড দামে বিক্রি হতে থাকে রড-সিমেন্ট-ইট-পাথর। প্রতি স্কয়ার ফুটে অতিরিক্ত দেড় থেকে তিন হাজার পর্যন্ত খরচ বেড়ে যায় প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের। পরে ক্রেতার কাছে বাড়তি দাম চেয়ে বসে কোম্পানি। এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে।
এমন ঘটনা বেশি ঘটে কোভিড পরবর্তীসময় ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে। বাড়তি দাম আর বর্ধিত দাম নেওয়া না নেওয়া নিয়ে বাঁধে বিপত্তি। এ নিয়ে অভিযোগ আসে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা রিহ্যাবে। বছরের অন্য সময় অভিযোগ এলেও এ দুই সময়ে অভিযোগের পাল্লা বেশি ভারী।
আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা ফ্ল্যাট কেনার জন্য অর্ধ কোটি টাকা ডাউন পেমেন্ট করি। পরে কিস্তিতে সব টাকা পরিশোধ করেছি। এর মধ্যে এক বছর বেশি সময় নিয়েছে আবাসন কোম্পানিটি। নির্মাণ উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন বেশি দাম চাচ্ছেন।’
মাসুম শেখ আবাসন কোম্পানির এক্সিকিউটিভ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা চলমান প্রকল্পে ক্রেতার কাছ থেকে ডাউন পেমেন্ট নিয়েছি। আমাদের কাজ চলমান থাকা অবস্থায় নির্মাণের প্রতিটি উপকরণের দাম বেড়েছে। এতে আমাদের প্রতি স্কয়ার ফুটে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বেশি অর্থের জোগান দিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী হতে পারে। সমঝোতার ভিত্তিতে অবশ্যই বেশি দাম দিতে হবে।’
তবে তাদের কোনো পক্ষই সমঝোতায় আসতে পারেনি। দু’পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। অভিযোগ আসে রিহ্যাব মেডিয়েশন সেলে। তাদের এ বিষয়ে শুনানি হয়, পরে উভয়ের সমঝোতায় চলমান প্রকল্পের সময় বাড়তি দাম ধরেই নতুন দর নির্ধারণ হয় ফ্ল্যাটটির।
এমন আরও একাধিক অভিযোগ আসে বিভিন্ন সময়। এ নিয়ে রিহ্যাব মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে জরুরি সভা আহ্বান করে ২০২২ সালের মাঝামাঝি। সভার সিদ্ধান্তে বলা হয়, ‘বৈশ্বিক ক্রমঅবনতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও মার্কিন ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে চলমান রিয়েল এস্টেট প্রকল্পগুলো নির্মাণসামগ্রীর অতিরিক্ত দামের কারণে আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে দেশে চলমান বা নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলোর যদি ১০ শতাংশের বেশি মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ে নির্মাণ সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কাজের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সমঝোতার ভিত্তিতে বর্ধিত বিক্রিমূল্য পুনর্নির্ধারণ হবে। আর কাজ শুরুর পর অতিরিক্ত খরচ (রড-সিমেন্ট ইত্যাদির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব) ১০ শতাংশের কম হলে আগের দামেই ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হবে।’
রিহ্যাব সূত্র বলছে, আবাসনে ফ্ল্যাট কেনাবেচায় অনিয়ম বা ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট দিতে গড়িমসি করাসহ নানা অভিযোগের বিষয়ে খোলা হয় রিহ্যাব মেডিয়েশন অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস সেল। এখানে ক্রেতা-বিক্রেতার অভিযোগ পড়েই। মেডিয়েশন সেলে ২০০৪ থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত মোট এক হাজার ১৭৬টি অভিযোগ পড়ে। এসব অভিযোগের অর্ধেকই পড়েছিল কোভিড পরবর্তী বা রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতির মধ্যে। তবে এসব অভিযোগের সিংহভাগই মীমাংসিত। এখনো ৩৪টি অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য পড়ে আছে। যেগুলোর শুনানি চলমান।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, সম্প্রতি আবাসন খাতসংশ্লিষ্ট নির্মাণসামগ্রীর দাম আকাশছোঁয়া। নির্মাণের অপরিহার্য উপকরণ রডের দাম ইতিহাসের সব রেকর্ড ভেঙেছে। খুচরা বাজারে প্রতি টন রড লাখ টাকায় বিক্রি হয়। উচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে সিমেন্টসহ অন্য নির্মাণসামগ্রী। রেকর্ড গড়েছে ইট, বালু, ভরাট বালু, পাথরও। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নির্মাণে জড়িত শ্রমিকের খরচও। মূল্যবৃদ্ধির এ প্রভাব পড়েছে আবাসন প্রকল্পগুলোতে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, নির্মাণসামগ্রীর দামের সঙ্গে কনস্ট্রাকশনের খরচও বেড়েছে। প্রতি স্কয়ার ফুটে দেড় থেকে তিন হাজার টাকা বাড়তি খরচ বহন করতে হচ্ছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের। এতে বাড়তি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন বিক্রেতা। এ কারণে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনায় আগ্রহ কমেছে ক্রেতার। বিক্রি না হওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। বড় অর্থ সংকটে রয়েছেন ছোট বিনিয়োগকারীরা। সরকার মধ্যবিত্তদের আবাসন সমস্যা দূর করার যে স্বপ্ন দেখিয়েছে তা ভণ্ডুল হতে পারে। বিভিন্ন উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন। নগরে সবার আবাসন গড়তে এখনই নির্মাণ উপকরণের দাম কমানোর দাবি তাদের।
এখনো অবিক্রীত ৫ হাজার ফ্ল্যাট
প্রতি বছর দেশে প্রায় ১৫ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি হয়। তবে, সদ্যবিদায়ী অর্থবছরের প্রায় পাঁচ হাজার ফ্ল্যাট অবিক্রীত রয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যেখানে ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়েছিল ১৫ হাজার, সেখানে বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে বিক্রি হয়েছে প্রায় ১০ হাজার। এছাড়া ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত গড়ে বিক্রি হয়েছিল ১৫ হাজার করে ফ্ল্যাট। ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বিক্রি হয় গড়ে ১২ হাজার ৫শ ফ্ল্যাট। ২০১৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ১৪ হাজার এবং ২০২১ সালে বিক্রি হয় ১৫ হাজার ফ্ল্যাট।
সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় রিহ্যাব সহ-সভাপতি (প্রথম) কামাল মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইউএস ডলারের অস্বাভাবিক দাম বাড়ে। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে খাতের আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, বিশেষ করে রডের কাঁচামালের দাম বাড়ে। এতে ফ্ল্যাটের খরচ বেড়ে যায়, ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় কোনো কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর যৌক্তিক সমাধান আনা হয়েছে।’
‘কোনো প্রকল্পে ১০ শতাংশ বা তার বেশি দ্রব্যমূল্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটি ক্রেতা-বিক্রেতার সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান হবে। এর নিচে খরচ হলে আগের দামেই বিক্রি করতে হবে কোম্পানিকে। এখানে ক্রেতা-বিক্রেতার কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হোক আমরা চাই না।’ জাগোনিউজ